শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

বলিলাম, নবীনটাও কম পাজী নয়। কাজকর্ম করবে না, কেবল টেরি কেটে আর মাছ ধরে বেড়াবে, আর হাতে পয়সা পেলেই তাড়ি খেয়ে মারপিট শুরু করবে। বলা বাহুল্য, এ-সকল সে শহরে শিখিয়া আসিয়াছিল।

দুই-ই সমান! বলিয়া সে ভিতরে চলিয়া গেল। বলিতে বলিতে গেল, কাজকর্ম করবেই বা কখন? হারামজাদী তার সময় দিলে ত!

বস্তুতঃ অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল। ইহাদের গালিগালাজ ও মারামারির মকদ্দমা আরও বার-দুই করিয়াছি—কোন ফল হয় নাই। আজ ভাবিলাম খাওয়া-দাওয়ার পরে ডাকাইয়া আনিয়া এইবার শেষ মীমাংসা করিয়া দিব। কিন্তু ডাকিতে হইল না, দুপুরবেলা পাড়ার মেয়ে-পুরুষে বাড়ি ভরিয়া গেল। নবীন কহিল, বাবুমশায়, ওকে আর আমি চাইনে—নষ্ট মেয়েমানুষ। ও আমার ঘর থেকে দূর হয়ে যাক।

মুখরা মালতী ঘোমটার ভিতর হইতে কহিল, ও আমার শাঁখা-নোয়া খুলে দিক।

নবীন বলিল, তুই আমার রুপোর পৈঁচে ফিরিয়ে দে।

মালতী তৎক্ষণাৎ হাত হইতে সে-দুইগাছা টানিয়া খুলিয়া দূর করিয়া ফেলিয়া দিল।

নবীন কুড়াইয়া লইয়া কহিল, আমার টিনের তোরঙ্গ তুই নিতে পাবিনে।

মালতী কহিল, আমি চাইনে। এই বলিয়া সে আঁচল হইতে চাবি খুলিয়া তাহার পায়ের কাছে ছুঁড়িয়া দিল।

নবীন তখন বীরদর্পে অগ্রসর হইয়া মালতীর শাঁখা পটপট করিয়া ভাঙ্গিয়া দিল এবং নোয়াগাছটা টানিয়া খুলিয়া প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া দূর করিয়া ফেলিয়া দিল। কহিল, যা, তোকে বিধবা করে দিলাম।

আমি ত অবাক হইয়া গেলাম। একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি তখন বুঝাইয়া বলিল যে, এরূপ না হইলে মালতীর নিকা করা আর হইত না—সমস্তই ঠিকঠাক আছে।

কথায় কথায় ব্যাপারটা আরও বিশদ হইল। বিশ্বেশ্বরের বড়জামায়ের ভাই আজ ছয় মাস ধরিয়া হাঁটাহাঁটি করিতেছে। তাহার অবস্থা ভাল, বিশুকে সে কুড়ি টাকা নগদ দিবে, এবং মালতীকে পায়ে মল, হাতে রুপোর চুড়ি এবং নাকে সোনার নথ দিবে বলিয়াছে, এমন কি এগুলি সে বিশুর কাছে জমা রাখিয়া পর্যন্ত দিয়াছে।

শুনিয়া সমস্ত জিনিসটাই অত্যন্ত বিশ্রী ঠেকিল। কিছুদিন হইতে যে একটা কদর্য ষড়যন্ত্র চলিতেছিল, তাহা নিঃসন্দেহ, এবং না জানিয়া হয়ত আমি তাহার সাহায্যই করিলাম। নবীন কহিল, আমি ত এই চাই। শহরে গিয়ে এবার মজা করে চাকরি করব—তোর মত অমন দশগণ্ডা বিয়ে করব। রাঙামাটির হরি মোড়ল ত তার মেয়ের জন্য সাধাসাধি করচে, তার পায়ের নোখেও তুই লাগিস নে। এই বলিয়া সে তাহার রূপার পৈঁচা ও তোরঙ্গের চাবি ট্যাঁকে গুঁজিয়া চলিয়া গেল। এই আস্ফালন সত্ত্বেও কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া মনে হইল না যে, তাহার শহরের চাকরি কিংবা হরি মোড়লের মেয়ে কোনটার আশাই তাহার ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করিয়া ধরিয়াছে।

রতন আসিয়া কহিল, বাবু, মা বলচেন এ-সব নোংরা কাণ্ড বাড়ি থেকে বিদায় করুন।

আমাকে করিতে কিছু হইল না, বিশ্বেশ্বর মোড়ল তাহার মেয়েকে লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; কিন্তু পাছে আমার পায়ের ধুলো লইতে আসে, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি গিয়া ঘরে ঢুকিলাম। ভাবিবার চেষ্টা করিলাম, যাক, যা হইল তা ভালই হইল। মন যখন ভাঙ্গিয়াছে এবং উপায় যখন আছে, তখন ব্যর্থ আক্রোশে নিত্য-নিয়ত মারামারি কাটাকাটি করিয়া ঘর করার চেয়ে এ ভাল।

কিন্তু আজ সুনন্দার বাটী হইতে ফিরিয়া শুনিলাম, গত কল্যকার নিষ্পত্তি অমন নিছক ভালই হয় নাই। সদ্যবিধবা মালতীর উপর নবীন স্বামীত্বের দাবি-দাওয়া সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করিলেও মারপিটের অধিকার ছাড়ে নাই। সে এ-পাড়া হইতে ও-পাড়ায় গিয়া হয়ত সমস্ত সকালটা লুকাইয়া অপেক্ষা করিয়াছে এবং এক সময়ে একাকী পাইয়া বিষম কাণ্ড করিয়া আসিয়াছে। কিন্তু মেয়েটাই বা গেল কোথায়?

সূর্য অস্ত গেল। পশ্চিমের জানালা দিয়া মাঠের দিকে চাহিয়া ভাবিতেছিলাম, খুব সম্ভব মালতী পুলিশের ভয়ে কোথায় লুকাইয়া আছে, কিন্তু নবীনকে সে যে ধরাইয়া দিয়াছে, ভালই করিয়াছে। হতভাগার উপযুক্ত শাস্তি হইয়াছে—মেয়েটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিবে।

রাজলক্ষ্মী সন্ধ্যার প্রদীপ হাতে ঘরে ঢুকিয়া ক্ষণকাল থমকিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু কোন কথা কহিল না। নীরবে বাহির হইয়া পাশের ঘরের চৌকাঠে পা দিয়াই কিন্তু কি একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই অস্ফুট চীৎকার করিয়া উঠিল। ছুটিয়া গিয়া দেখি মস্ত একটা কাপড়ের পুঁটুলি দুই হাত বাড়াইয়া তাহার পা ধরিয়া তাহারি উপর মাথা খুঁড়িতেছে। রাজলক্ষ্মীর হাতের প্রদীপটা পাড়িয়া গেলেও জ্বলিতেছিল, তুলিয়া ধরিতেই সেই মিহি সূতার চওড়া কালাপেড়ে শাড়ি চোখে পড়িল!

বলিলাম, এ মালতী!

রাজলক্ষ্মী কহিল, হতভাগী, সন্ধ্যাবেলায় আমায় ছুঁলি? ইস্! এ কি বল্‌ ত?

প্রদীপের আলোকে ঠাহর করিয়া দেখিলাম, তাহার মাথার ক্ষত হইতে পুনরায় রক্ত ঝরিয়া অপরের পা-দুখানি রাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছে, এবং সঙ্গে সঙ্গেই হতভাগিনীর কান্না যেন শতধারে ফাটিয়া পড়িল; কহিল, মা, আমাকে বাঁচাও—

রাজলক্ষ্মী কটুকণ্ঠে কহিল, কেন, তোর আবার হ’ল কি?

সে কাঁদিয়া কহিল, দারোগা বলচে কাল সকালেই তাকে চালান দেবে—দিলেই পাঁচ বচ্ছরের জেল হয়ে যাবে।

আমি কহিলাম, যেমন কর্ম তেমনি শাস্তি হওয়া ত চাই।

রাজলক্ষ্মী কহিল, হ’লই বা জেল, তাতে তোর কি?

মেয়েটার কান্না যেন দমকা ঝড়ের মত তাহার বুক ফাটিয়া উঠিল; বলিল, বাবু বলেন বলুন, মা, ও-কথা তুমি ব’লো না—তার মুখের ভাত আমি খেতে দিইনি। বলিতে বলিতে সে আবার মাথা কুটিতে লাগিল; কহিল, মা, আমাদের তুমি এইবারটি বাঁচিয়ে দাও, আমরা বিদেশে কোথাও চলে গিয়ে ভিক্ষে করে খাব। নইলে তোমারি পুকুরে গিয়ে ডুব দিয়ে মরব।

হঠাৎ রাজলক্ষ্মীর দুই চোখ দিয়া বড় বড় জলের ফোঁটা গড়াইয়া পড়িল; ধীরে ধীরে তাহার একরাশ এলোচুলের উপর হাত রাখিয়া রুদ্ধস্বরে কহিল, আচ্ছা আচ্ছা, তুই চুপ কর্—আমি দেখচি।

দেখিতেও হইল। রাজলক্ষ্মীর বাক্স হইতে শ’-দুই টাকা সেই রাত্রেই কোথায় গিয়া অন্তর্হিত হইল, তাহা বলিবার প্রয়োজন নাই; কিন্তু নবীন মোড়ল কিংবা মালতী কাহাকেও সকাল হইতে গঙ্গামাটিতে দেখিত পাওয়া গেল না।

0 Shares