শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

নেই কেন তাই শুনি?

সে জবাব দিল, দু-তিনদিন জানিয়েচি আপনাকে ঘি ফুরিয়েচে, লোক পাঠান। আপনি না পাঠালে আমার দোষ কি?

সংসার খরচের সাধারণ ঘি এইখানেই পাওয়া যাইত, কিন্তু আমার জন্য আসিত সাঁইথিয়ার নিকটবর্তী কি একটা গ্রাম হইতে। তাহা লোক পাঠাইয়া আনাইয়া লইতে হইত।

কথাটা রাজলক্ষ্মীর অন্যমনস্ক কর্ণরন্ধ্রে হয় প্রবেশ করে নাই, না হয় ত সে ভুলিয়াছে।জিজ্ঞাসা করিল, কবে থেকে নেই মহারাজ?

তা হবে পাঁচ-সাতদিন।

এই পাঁচ-সাতদিন তাঁকে ভাত খাওয়াচ্চ? রতনকে ডাকিয়া কহিল, আমিই যেন ভুলেছিলাম, কিন্তু তুই কি আনিয়ে দিতে পারতিস নে বাবা! এম্‌নি করেই কি সবাই মিলে আমাকে জব্দ করতে হয়!

রতন মনে মনে তাহার ঠাকুরানীর উপর খুশি ছিল না। দিবারাত্রি বাড়ি ছাড়িয়া অন্যত্র থাকায় এবং বিশেষ করিয়া আমার প্রতি ঔদাসীন্যে তাহার বিরক্তির একশেষ হইয়া ছিল, কর্ত্রীর অনুযোগের উত্তরে ভালমানুষের মত মুখ করিয়া কহিল, কি জানি মা, তুমি গেরাহ্যি করলে না দেখে ভাবলুম ভাল দামী ঘি বোধ হয় আর চাইনে। নইলে পাঁচ-ছদিন ধরে রোগামানুষকে আমি ভাত খেতে দিই!

রাজলক্ষ্মীর বলিবার কিছুই ছিল না, তাই ভৃত্যের কাছে এতবড় খোঁচা খাইয়াও সে কিছুক্ষণ নিরুত্তরে বসিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল।

রাত্রে বিছানায় শুইয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত ছটফট করিয়া বোধ করি সেইমাত্র তন্দ্রা আসিয়াছিল, রাজলক্ষ্মী দ্বার ঠেলিয়া ঘরে ঢুকিল এবং আমার পায়ের কাছে আসিয়া বহুক্ষণ পর্যন্ত নিঃশব্দে বসিয়া থাকিয়া ডাকিল, তুমি কি ঘুমোলে?

বলিলাম, না,

রাজলক্ষ্মী কহিল, তোমাকে পাবার জন্যে আমি যা করেচি, তার অর্ধেক করলেও বোধ হয় ভগবানকে এতদিনে পেতুম। কিন্তু তোমাকে পেলুম না।

বলিলাম, হতে পারে মানুষকে পাওয়া আরও শক্ত।

মানুষকে পাওয়া? রাজলক্ষ্মী একমুহুর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, যাই হোক, ভালবাসাটাও ত একরকমের বাঁধন, বোধ হয় এও তোমার সয় না— গায়ে লাগে।

এ অভিযোগের জবাব নাই, এ অভিযোগ শাশ্বত ও সনাতন। আদিম মানব-মানবী হইতে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এ কলহের মীমাংসক কেহ নাই—এ বিবাদ যেদিন মিটিবে, সংসারের সমস্ত রস, সমস্ত মাধুর্য সেদিন তিক্ত বিষ হইয়া উঠিবে। তাই উত্তর দিবার চেষ্টামাত্র না করিয়া নীরব হইয়া রহিলাম।

কিন্তু আশ্চর্য এই যে, উত্তরের জন্য রাজলক্ষ্মী পীড়াপীড়ি করিল না। জীবনের এতবড় সর্বব্যাপী প্রশ্নটাকেও সে যেন এক নিমিষে আপনা-আপনিই ভুলিয়া গেল। কহিল, ন্যায়রত্ন ঠাকুর বলছিলেন একটা ব্রতের কথা,—কিন্তু একটু বলে সবাই নিতে পারে না, আর এত সুবিধাই বা ক’জনের ভাগ্যে জোটে?

অসমাপ্ত প্রস্তাবের মাঝখানে মৌন হইয়া রহিলাম; সে বলিতে লাগিল, তিনদিন একরকম উপোস করেই থাকতে হয়, সুনন্দারও ভারি ইচ্ছে,—দু’জনের একসঙ্গেই তা হলে হয়ে যায়, কিন্তু—এই বলিয়া সে নিজেই একটু হাসিয়া বলিল, তোমার মত না হলে ত আর—

জিজ্ঞাসা করিলাম, আমার মত না হলে কি হবে?

রাজলক্ষ্মী বলিল, তা হলে হবে না।

কহিলাম, তবে এ মতলব ত্যাগ কর, আমার মত নেই।

যাও—তামাশা করতে হবে না।

তামাশা নয়, সত্যি আমার মত নেই—আমি নিষেধ করচি

কথা শুনিয়া রাজলক্ষ্মীর মুখ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া বলিল, কিন্তু আমরা যে সমস্ত স্থির করে ফেলেচি। জিনিসপত্র কিনতে লোক গেছে—কাল হবিষ্যি করে পরশু থেকে যে—বাঃ! এখন বারণ করলে হবে কেন? সুনন্দার কাছে আমি মুখ দেখাব কি করে? ছোটঠাকুর—বাঃ! এ কেবল তোমার চালাকি। আমাকে মিছিমিছি রাগাবার জন্যে—না, সে হবে না, তুমি বল তোমার মত আছে।

বলিলাম, আছে। কিন্তু তুমি কোনদিনই ত আমার মতামতের অপেক্ষা কর না লক্ষ্মী, আজই বা হঠাৎ কেন তামাশা করতে এলে? আমার আদেশ মানতে হবে এ দাবি আমি ত কখনো তোমার কাছে করিনি!

রাজলক্ষ্মী আমার পায়ের উপর হাত রাখিয়া কহিল, আর কখনও হবে না, এইবারটি শুধু প্রসন্ন মনে আমাকে হুকুম দাও।

কহিলাম, আচ্ছা। কিন্তু ভোরেই তোমাকে হয়ত যেতে হবে, আর রাত ক’রো না শুতে যাও।

রাজলক্ষ্মী গেল না, আস্তে আস্তে আমার পায়ের উপর হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। যতক্ষণ না ঘুমাইয়া পড়িলাম ঘুরিয়া ঘুরিয়া বার বার কেবলি মনে হইতে লাগিল, সে স্নেহস্পর্শ আর নাই। সেও ত বেশিদিনের কথা নয়, আরা রেলওয়ে স্টেশন হইতে আমাকে যেদিন সে কুড়াইয়া বাড়ি আনিয়াছিল, সেদিন এমনি করিয়াই পায়ে হাত বুলাইয়া আমাকে সে ঘুম পাড়াইতে ভালবাসিত। ঠিক এমনিই নীরবে, কিন্তু মনে হইত তাহার দশ অঙ্গুলি যেন দশ ইন্দ্রিয়ের সমস্ত ব্যাকুলতা দিয়া নারীহৃদয়ের যাহা-কিছু আছে, সমস্ত নিঃশেষ করিয়া আমার এই পা-দুটার উপরে উজাড় করিয়া দিতেছে। অথচ, এ আমি চাহি নাই, এই লইয়াই যে কেমন করিয়া কি করিব সেও ভাবিয়া পাই নাই। বানের জলের মত—আসার দিনেও আমার মত চাহে নাই, হয়ত যাবার দিনেও তেমনি মুখ চাহিবে না। চোখ দিয়া আমার সহজে জল পড়ে না, ভালবাসার কাঙালবৃত্তি করিতেও আমি পারি না। জগতে কিছুই নাই, কাহারো কাছে কিছু পাই নাই, দাও দাও বলিয়া হাত বাড়াইয়া থাকিতে আমার লজ্জা করে। বইয়ে পড়িয়াছি এই লইয়া কত বিরোধ, কত জ্বালা, মান-অভিমানের কতই না প্রমত্ত আক্ষেপ—স্নেহের সুধা গরল হইয়া উঠার কত না বিক্ষুব্ধ কাহিনী! এ-সকল মিথ্যা নয় জানি, কিন্তু আমার মনের মধ্যে যে বৈরাগী তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল, হঠাৎ চমক ভাঙ্গিয়া বলিতে লাগিল ছি ছি ছি!

বহুক্ষণ পরে, ঘুমাইয়া পড়িয়াছি মনে করিয়া রাজলক্ষ্মী যখন সাবধানে ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল, তখন জানিতেও পারিল না যে, নিদ্রাবিহীন নিমীলিত চোখের কোণ দিয়া আমার অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছে। অশ্রু পড়িতেই লাগিল, কিন্তু আজিকার আয়ত্তাতীত ধন একদিন আমারই ছিল বলিয়া ব্যর্থ হাহাকারে অশান্তি সৃষ্টি করিয়া তুলিতে আর প্রবৃত্তি হইল না।

0 Shares