শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

ছেলেটা বলিল, জল—

মুখের উপর ঝুঁকিয়া কহিলাম, জল নেই বাবা, সকাল হোক।

ছেলেটা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, তারপর চোখ বুজিয়া নিঃশব্দে রহিল।

তৃষ্ণার জল না থাক, কিন্তু আমার চোখ ফাটিয়া জল আসিল। হায় রে হায়! শুধু কেবল মানবের সুকুমার হৃদয়বৃত্তিই নয়, নিজের সুদুঃসহ যাতনার প্রতিও কি অপরিসীম ঔদাসীন্য! এই ত পশু! এ ধৈর্যশক্তি নয়, জড়তা। এ সহিষ্ণুতা মানবতার ঢের নীচের স্তরের বস্তু।

আমাদের ট্রাকের অন্য লোকগুলা অকাতরে ঘুমাইতেছে। কালি-পড়া হ্যারিকেনের অত্যন্ত মলিন আলোকেও আমি স্পষ্ট দেখিতেছিলাম, মা ও ছেলে উভয়েরই সর্বাঙ্গ ব্যাপিয়া খিল ধরিয়াছে। কিন্তু কি-ই-বা আমার করিবার ছিল!

সম্মুখে কালো আকাশের অনেকখানি স্থান ব্যাপিয়া সপ্তর্ষিমন্ডল জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছে, সেদিকে চাহিয়া আমি বেদনায়, ক্ষোভে ও নিষ্ফল আক্ষেপে বার বার করিয়া অভিসম্পাত করিতে লাগিলাম, আধুনিক সভ্যতার বাহন তোরা—তোরা মর্‌। কিন্তু যে নির্মম সভ্যতা তোদের এমনধারা করিয়াছে তাহাকে তোরা কিছুতেই ক্ষমা করিস না। যদি বহিতেই হয়, ইহাকে তোরা দ্রুতবেগে রসাতলে বহিয়া নিয়া যা।

পরিচ্ছেদ – বার

সকালে খবর পৌঁছিল আর দুই জন পীড়িত হইয়াছে। ঔষধ দিলাম, জমাদার সাঁইথিয়ায় সংবাদ পাঠাইয়া দিল। আশা করিলাম, এবার কর্তৃপক্ষের আসন টলিবে।

বেলা নয়টা আন্দাজ ছেলেটা মরিল। ভালই হইল। এই ত ইহাদের জীবন!

সম্মুখের মাঠের পথ দিয়া দুই জন ভদ্রলোক ছাতা মাথায় দিয়া চলিয়াছিলেন; কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, এখানে গ্রাম কত দূরে?

যিনি বৃদ্ধ, তিনি মুখটা ঈষৎ উঁচু করিয়া বলিলেন, ঐ যে!

জিজ্ঞাসা করিলাম, খাবার জিনিস কিছু মেলে?

অন্যজন বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিলেন, মেলে না কি রকম! ভদ্রলোকের গ্রাম—চাল, ডাল, ঘি, তেল, তরিতরকারি যা খুশি আপনার। আসছেন কোথা থেকে? নিবাস? মশায়, আপনারা?

সংক্ষেপে তাঁহাদের কৌতূহল নিবৃত্তি করিয়া সতীশ ভরদ্বাজের নাম করিতে উভয়ে রুষ্ট হইয়া উঠিলেন; বৃদ্ধ বলিলেন, মাতাল, বদমাইস, জোচ্চোর! ইনি কোন্‌-একটা হাইস্কুলের হেডমাস্টার।

তাঁহার সঙ্গী কহিলেন, রেলের লোক আর কত ভাল হবে! কাঁচা পয়সাটা বেশ হাতে ছিল কিনা!

প্রত্যুত্তরে সতীশের টাটকা কবরের ঢিপিটা আমি হাত দিয়া দেখাইয়া জানাইলাম, এখন তাহার সম্বন্ধে আলোচনা বৃথা। কাল সে মরিয়াছে, লোকাভাবে দাহ করিতে পারা যায় নাই, ঐখানে মাটি দিতে হইয়াছে।

বলেন কি! বামুনের ছেলেকে—

কিন্তু উপায় কি?

শুনিয়া উভয়েই ক্ষুব্ধ হইয়া জানাইলেন যে, ভদ্রলোকের গ্রাম, একটুখানি খবর পাইলে যা হোক একটা উপায় নিশ্চয় হইয়া যাইত। একজন প্রশ্ন করিলেন, আপনি তাঁর কে?

বলিলাম, কেউ না। সামান্য পরিচয় ছিল মাত্র। এই বলিয়া কি করিয়া এখানে জুটিলাম সংক্ষেপে তাহারই বিবরণ দিলাম। দুইদিন খাওয়া হয় নাই, অথচ, কুলিদের মধ্যে কলেরা শুরু হইয়া গিয়াছে বলিয়া ছাড়িয়াও যাইতে পারিতেছি না।

খাওয়া হয় নাই শুনিয়া তাঁহারা অতিশয় উদ্বিগ্ন হইলেন, এবং সঙ্গে যাইবার জন্য বারংবার আগ্রহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। এবং, এই ভয়ানক ব্যাধির মধ্যে খালি পেটে থাকা যে মারাত্মক ব্যাপার তাহাও একজন জানাইয়া দিলেন।

বেশি বলিতে হইল না—বলার প্রয়োজনই ছিল না, ক্ষুৎপিপাসায় মৃতকল্প হইয়া উঠিয়াছিলাম—তাঁহাদের সঙ্গ লইলাম। পথে এই বিষয়েই আলাপ হইতে লাগিল। পাড়াগাঁয়ের লোক, শহরের শিক্ষা বলিতে যাহা বুঝায় তাহা তাঁহাদের ছিল না, কিন্তু মজা এই যে ইংরাজ রাজত্বের খাঁটি পলিটিক্সটুকু তাঁহাদের অপরিজ্ঞাত নয়। এ যেন দেশের লোকে দেশের মাটি হইতে, জল হইতে, আকাশ হইতে, বাতাস হইতে অস্থিমজ্জা দিয়া সংগ্রহ করিয়া লইয়াছে।

উভয়েই কহিলেন, সতীশ ভরদ্বাজের দোষ নেই মশায়, আমরা হলেও ঠিক অমনি হয়ে উঠতাম। কোম্পানি বাহাদুরের সংস্পর্শে যে আসবে সে-ই চোর না হয়ে পারবে না। এমনি এঁদের ছোঁয়াচের গুণ!

ক্ষুধার্ত ও একান্ত ক্লান্ত দেহে অধিক কথা কহিবার শক্তি ছিল না, সুতরাং চুপ করিয়াই রহিলাম। তিনি বলিতে লাগিলেন, কি দরকার ছিল মশাই, দেশের বুক চিরে আবার একটা রেলের লাইন পাতবার? কোন লোকে কি তা’ চায়? চায় না।

কিন্তু তবু চাই। দীঘি নেই, পুকুর নেই, কুয়ো নেই, কোথাও একফোঁটা খাবার জল নেই, গ্রীষ্মকালে গরু-বাছুরগুলো জলাভাবে ধড়ফড় করে মরে যায়—কোথাও একটু ভাল খাবার জল থাকলে কি সতীশবাবুই মারা যেতেন? কখ্‌খনো না। ম্যালেরিয়া, কলেরা হর্‌-রকমের ব্যাধি পীড়ায় লোক উজোড় হয়ে গেল, কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! কর্তারা আছেন শুধু রেলগাড়ি চালিয়ে কোথায় কার ঘরে কি শস্য জন্মেছে শুষে চালান করে নিয়ে যেতে। কি বলেন মশাই? ঠিক নয়?

আলোচনা করিবার মত গলায় জোর ছিল না বলিয়াই শুধু ঘাড় নাড়িয়া নিঃশব্দে সায় দিয়া মনে মনে সহস্রবার বলিতে লাগিলাম, এই, এই, এই! কেবলমাত্র এইজন্য তেত্রিশ কোটি নরনারীর কণ্ঠ চাপিয়া বিদেশীয় শাসনতন্ত্র ভারতে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। শুদ্ধমাত্র এই হেতুই ভারতের দিকে দিকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে রেলপথ বিস্তারের আর বিরাম নাই। বাণিজ্যের নাম দিয়া ধনীর ধনভাণ্ডার বিপুল হইতে বিপুলতর করিবার এই অবিরাম চেষ্টায় দুর্বলের সুখ গেল, শান্তি গেল, অন্ন গেল, ধর্ম গেল—তাহার বাঁচিবার পথ দিনের পর দিন সঙ্কীর্ণ ও নিরন্তর বোঝা দুর্বিষহ হইয়া উঠিতেছে—এ সত্য ত কাহারও চক্ষু হইতেই গোপন রাখিবার জো নাই।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি আমার এই চিন্তাতেই যেন বাক্যযোজনা করিয়া কহিলেন, মশাই, ছেলেবেলায় মামার বাড়িতে মানুষ আমি, আগে বিশ ক্রোশের মধ্যে রেলগাড়ি ছিল না, তখন কি সস্তা, আর কি প্রচুর জিনিসপত্রই না সেখানে ছিল। তখন কারও কিছু জন্মালে পাড়াপ্রতিবেশী সবাই তার একটু ভাগ পেত, এখন থোড়, মোচা, উঠোনের দুই-আঁটি শাক পর্যন্ত কেউ কাউকে দিতে চায় না, বলে, থাক, সাড়ে-আটটার গাড়িতে পাইকেরের হাতে তুলে দিলে দু’পয়সা আসবে। এখন দেওয়ার নাম হয়েচে অপব্যয়—মশাই, দুঃখের কথা বলতে কি, পয়সা-করার নেশায় মেয়ে-পুরুষে সবাই যেন একেবারে ইতর হয়ে গেছে।

0 Shares