শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

ভদ্রলোক রাগ করিলেন। বলিলেন, কেন, এসব মিথ্যে নাকি? একটি অক্ষরও মিথ্যে নয় জানবেন।

না না, মিথ্যে ত বলিনি, তবু—

তবু আবার কি? আমাদের স্বামীজী কখনো মিথ্যে উচ্চারণ করেন না। তাঁর মত জ্ঞানী কেউ আছে নাকি?

প্রশ্ন করিলাম, স্বামীজী কে?

ভদ্রলোকের সঙ্গীটি ইহার উত্তর দিলেন। কহিলেন, স্বামী বজ্রানন্দ। বয়সে কম হলে কি হয়, অগাধ পণ্ডিত, অগাধ—

তাঁকে আপনারা চেনেন নাকি?

চিনিনে? বেশ! তিনি আমাদের আপনার লোক বললেই যে হয়! এঁর বাড়িতেই যে তাঁর প্রধান আড্ডা! এই বলিয়া তিনি সঙ্গের ভদ্রলোকটিকে দেখাইয়া দিলেন।

বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ সংশোধন করিয়া কহিলেন, আড্ডা ব’লো না নরেন,—বল আশ্রম। মশাই, আমি গরীব, যা পারি তাঁর সেবা করি। কিন্তু এ যেন বিদুরের গৃহে শ্রীকৃষ্ণ। মানুষ ত নয়, মানুষের আকৃতিতে দেবতা।

জিজ্ঞাসা করিলাম, সম্প্রতি কতদিন আছেন আপনাদের গ্রামে?

নরেন কহিলেন, প্রায় মাস-দুই হবে। এ অঞ্চলে না আছে একটা ডাক্তার-বদ্যি, না আছে একটা ইস্কুল। এর জন্যেই তাঁর যত পরিশ্রম। আবার নিজেও একজন মস্ত ডাক্তার।

এতক্ষণে ব্যাপারটা বেশ স্পষ্ট হইল। ইনিই সেই আনন্দ। সাঁইথিয়া স্টেশনে আহারাদি করাইয়া রাজলক্ষ্মী যাঁহাকে পরম সমাদরে গঙ্গামাটিতে আনিয়াছিল। সেই বিদায়ের ক্ষণটি মনে পড়িল। রাজলক্ষ্মীর সে কি কান্না! পরিচয় ত মাত্র দু’দিনের, কিন্তু কত বড় স্নেহের বস্তুকেই যেন চোখের আড়ালে কোন্‌ ভয়ানক বিপদের মুখে পাঠাইয়া দিতেছে এমনি তাহার ব্যথা। ফিরিয়া আসিবার সে কি ব্যাকুল অনুনয়! কিন্তু আনন্দ সন্ন্যাসী। তাহার মমতাও নাই, মোহ নাই। নারী হৃদয়ের বেদনার রহস্য তাহার কাছে মিথ্যা বৈ আর কিছুই নয়। তাই এতদিন এত কাছে থাকিয়াও অপ্রয়োজনে দেখা দিবার প্রয়োজন সে পলকের জন্যও অনুভব করে নাই, এবং ভবিষ্যতে হয়ত কখনো এই প্রয়োজনের হেতু আসিবে না।

কিন্তু রাজলক্ষ্মী এ কথা শুনিলে যে কত বড় আঘাত পাইবে, সে শুধু আমিই জানি।

নিজের কথা মনে পড়িল। আমারও বিদায়ের মুহূর্ত আসন্ন হইয়া আসিতেছে—যাইতেই হইবে তাহা প্রতিনিয়তই উপলব্ধি করিতেছি—আমার প্রয়োজন রাজলক্ষ্মীর সমাপ্ত হইয়া আসিতেছে, কেবল ইহাই ভাবিয়া পাই না, সেদিনের দিনান্তটা রাজলক্ষ্মীর কোথা দিয়া কেমন করিয়া অবসান হইবে।

গ্রামে পৌঁছিলাম। নাম মামুদপুর। বৃদ্ধ যাদব চক্রবর্তী তাহারই উল্লেখ করিয়া সগর্বে কহিলেন, নাম শুনে চমকাবেন না মশাই, আমাদের চতুঃসীমানার মধ্যে মুসলমানের ছায়াটুকু পর্যন্ত মাড়াতে হয় না। যেদিকে তাকান ব্রাহ্মণ কায়স্থ আর সৎজাত। অনাচরণীয় জাতের বসতি পর্যন্ত নেই। কি বল নরেন, আছে?

নরেন সানন্দে সায় দিয়া বারংবার মাথা নাড়িয়া কহিল, একটিও না, একটিও না।তেমন গাঁয়ে আমরা বাস করিনে।

হইতে পারে সত্য, কিন্তু এত খুশি হইবারই বা কি আছে ভাবিয়া পাইলাম না।

চক্রবর্তী-গৃহে বজ্রানন্দের সাক্ষাৎ মিলিল। হাঁ তিনিই বটে। আমাকে দেখিয়া তাঁর যেমন বিস্ময়, তেমনি আনন্দ।

দাদা যে! হঠাৎ এখানে? এই বলিয়া আনন্দ হাত তুলিয়া নমস্কার করিলেন। এই নরদেহধারী দেবতাকে সসম্মানে অভিবাদন করিতে দেখিয়া চক্রবর্তী বিগলিত হইয়া গেলেন। আশেপাশে আরও অনেকগুলি ভক্ত ছিলেন, তাঁহারাও উঠিয়া দাঁড়াইলেন। আমি যেই হই, সামান্য ব্যক্তি যে নয়, এ সম্বন্ধে কাহারও সংশয় রহিল না।

আনন্দ কহিলেন, আপনাকে বড় রোগা দেখাচ্ছে দাদা?

উত্তর দিলেন চক্রবর্তী। আমার যে দিন-দুই আহার-নিদ্রা ছিল না, এবং বহু পুণ্যফলেই শুধু বাঁচিয়া আসিয়াছি ইহাই ব্যক্ত করিয়া কুলিদের মধ্যে মড়কের বিবরণ এম্‌নি সবিস্তারে বর্ণনা করিলেন যে, আমার পর্যন্ত তাক লাগিয়া গেল।

আনন্দ বিশেষ কোন ব্যাকুলতা প্রকাশ করিলেন না। ঈষৎ হাসিয়া, অপরের কান বাঁচাইয়া কহিলেন, এতটা দু’দিনের উপবাসে হয় না দাদা, একটু দীর্ঘকালের দরকার। কি হয়েছিল? জ্বর?

বলিলাম, আশ্চর্য নয়। ম্যালেরিয়া ত আছেই।

চক্রবর্তী আতিথ্যের ত্রুটি করিলেন না, খাওয়াটা আজ ভালরকমই হইল।

আহারান্তে প্রস্থানের আয়োজন করিতে আনন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি হঠাৎ কুলিদের মধ্যে জুটেছিলেন কি করে?

বলিলাম, দৈবের চক্রান্তে।

আনন্দ সহাস্যে কহিলেন, চক্রান্তই বটে। রাগের মাথায় বাড়িতে বোধ হয় খবরও দেননি?

বলিলাম, না, কিন্তু সে রাগ করে নয়। দেওয়া বাহুল্য বলেই দিইনি। তা ছাড়া লোকই বা পেতাম কোথায়?

আনন্দ বলিলেন, সে একটা কথা। কিন্তু আপনার ভাল-মন্দ দিদির কাছে বাহুল্য হয়ে উঠলো কবে থেকে? তিনি হয়ত ভয়ে ভাবনায় আধমরা হয়ে গেছেন।

কথা বাড়াইয়া লাভ নাই—এ প্রশ্নের আর জবাব দিলাম না। আনন্দ স্থির করিলেন জেরায় আমাকে একেবারে জব্দ করিয়া দিয়াছেন। তাই স্নিগ্ধ মৃদুহাস্যে ক্ষণকাল আত্মপ্রসাদ উপভোগ করিয়া কহিলেন, আপনার রথ প্রস্তুত, বোধ করি সন্ধ্যার পূর্বেই গিয়ে বাড়ি পৌঁছিতে পারবেন। আসুন, আপনাকে তুলে দিয়ে আসি।

বলিলাম, কিন্তু বাড়ি যাবার পূর্বে কুলিদের একটু খবর নিয়ে যেতে হবে।

আনন্দ বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন, তার মানে রাগ এখনো পড়েনি। কিন্তু আমি বলি, দৈবের ষড়যন্ত্রে দুর্ভোগ যা কপালে ছিল তা ফলেচে। আপনি ডাক্তারও নয়, সাধুবাবাও নয়, গৃহী লোক। এখন খবর নেবার যদি কিছু থাকে ত সে ভার আমাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি যান। কিন্তু গিয়ে আমার নমস্কার জানিয়ে বলবেন, তাঁর আনন্দ ভাল আছে।

দ্বারে গরুর গাড়ি তৈরি ছিল। গৃহস্বামী চক্রবর্তী আসিয়া সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইলেন, এদিকে আর যদি কখনো আসা হয় এ বাড়িতে যেন পদধূলি দিয়া যান। তাঁহার আন্তরিক আতিথ্যের জন্য সহস্র ধন্যবাদ দিলাম, কিন্তু দুর্লভ পদধূলির আশা দিতে পারিলাম না। বাঙ্গলাদেশ আমাকে অচিরে ছাড়িয়া যাইতে হইবে, এ কথা মনের মধ্যে অনুভব করিতেছিলাম, সুতরাং কোনদিন কোন কারণেই এ প্রদেশে ফিরিয়া আসার সম্ভাবনা আমার পক্ষে সুদূরপরাহত।

0 Shares