শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

দিন-তিনেক পরে সুস্থ হইয়া একদিন সকালে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া বলিলাম, মা, আজ আমাকে বিদায় দিন।

চক্রবর্তীগৃহিণীর দুই চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল; বলিলেন, দুঃখীর ঘরে অনেক দুঃখ পেলে বাবা, তোমাকে কটুকথাও কম বলিনি।

এ কথার উত্তর খুঁজিয়া পাইলাম না। না না, সে কিছুই না—আমি মহাসুখে ছিলাম, আমার কৃতজ্ঞতা—ইত্যাদি মামুলি ভদ্রবাক্য উচ্চারণ করিতেও আমার লজ্জা বোধ হইল। বজ্রানন্দের কথা মনে পড়িল। সে একদিন বলিয়াছিল, ঘর ছাড়িয়া আসিলে কি হইবে! এই বাঙ্গলাদেশের গৃহে গৃহে মা-বোন, সাধ্য কি তাঁহাদের স্নেহের আকর্ষণ এড়াইয়া যাই। কথাটা কতবড়ই না সত্য!

নিরতিশয় দারিদ্র্য ও নির্বোধ স্বামীর অবিবেচনার আতিশয্য এই গৃহস্থঘরের গৃহিণীকে প্রায় পাগল করিয়া দিয়াছে, কিন্তু যে মুহূর্তেই তিনি অনুভব করিলেন আমি পীড়িত, আমি নিরুপায়—আর তাঁহার ভাবিবার কিছু রহিল না। মাতৃত্বের সীমাহীন স্নেহে আমার রোগ ও পরগৃহবাসের সমস্ত দুঃখ যেন দুই হাত দিয়া মুছিয়া লইলেন।

চক্রবর্তী চেষ্টা করিয়া একখানি গো-যান সংগ্রহ করিয়া আনিলেন, গৃহিণীর ভারি ইচ্ছা ছিল আমি স্নানাহার করিয়া যাই, কিন্তু রৌদ্র বাড়িবার আশঙ্কায় পীড়াপীড়ি করিলেন না। শুধু যাত্রাকালে দেবদেবীর নাম স্মরণ করিয়া চোখ মুছিয়া কহিলেন, বাবা, যদি কখনও এদিকে এস আর একবার দেখা দিয়ে যেয়ো।

এদিকে আসাও কখনও হয় নাই, দেখা দিতেও আর পারি নাই, শুধু বহুদিন পরে শুনিয়াছিলাম, রাজলক্ষ্মী কুশারীমহাশয়ের হাত দিয়া তাঁহাদের অনেকখানি ঋণের অংশ গ্রহণ করিয়াছিল।

পরিচ্ছেদ – চৌদ্দ

গঙ্গামাটির বাটীতে আসিয়া যখন পৌঁছিলাম তখন বেলা প্রায় তৃতীয় প্রহর। দ্বারের উভয় পার্শ্বে কদলীবৃক্ষ ও মঙ্গলঘট বসান। উপরে আম্রপল্লবের মালা দোলানো। বাহিরে অনেকগুলি লোক বসিয়া জটলা করিয়া তামাক খাইতেছে। গরুর গাড়ির শব্দে তাহারা মুখ তুলিয়া চাহিল। বোধ হয় ইহারই মধুর শব্দে আকৃষ্ট হইয়া আর একজন যিনি অকস্মাৎ সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, দেখি, তিনি স্বয়ং বজ্রানন্দ। তাঁহার উল্লসিত কলরব উদ্দাম হইয়া উঠিল, এবং কে একজন ছুটিয়া ভিতরে খবর দিতেও গেল।স্বামীজী বলিতে লাগিলেন যে, তিনি আসিয়া সকল বিবরণ জানানো পর্যন্ত চারিদিকে লোক পাঠাইয়া তাঁহাকে খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টারও যেমন বিরাম নাই, বাড়িসুদ্ধ সকলের দুশ্চিন্তারও তেমনি অবধি নাই। ব্যাপার কি? অকস্মাৎ কোথায় ডুব দিয়েছিলেন বলুন ত? গাড়োয়ান ছোঁড়াটা ত গিয়ে বললে আপনাকে গঙ্গামাটির পথে নামিয়ে দিয়ে সে ফিরে গেছে।

রাজলক্ষ্মী কাজে ব্যস্ত ছিল, আসিয়া পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল, বলিল, বাড়িসুদ্ধ সবাইকে কি শাস্তিই তুমি দিলে! বজ্রানন্দকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, কিন্তু দেখ আনন্দ, আমার মন জানতে পেরেছিল যে আজ উনি আসবেনই।

হাসিয়া বলিলাম, দোরে কলাগাছ আর ঘটস্থাপনা দেখেই আমি বুঝেচি যে, আমার আসার খবরটি তুমি পেয়েচ।

কবাটের আড়ালে রতন আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, সে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, আজ্ঞে সেজন্যে নয়। আজ বাড়িতে ব্রাহ্মণভোজন হবে কিনা। বক্রেশ্বর দেখে এসে মা—

রাজলক্ষ্মী ধমক দিয়া তাহাকে থামাইয়া দিল, তোকে আর ব্যাখ্যা করতে হবে না রতন, নিজের কাজে যা।

তাহার আরক্ত মুখের প্রতি চাহিয়া বজ্রানন্দ হাসিয়া ফেলিল, কহিল, কি জানেন দাদা, কোন একটা কাজে লেগে না থাকলে মানসিক উৎকণ্ঠা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়, সহা যায় না। ভোজের আয়োজনটা কেবল এইজন্যেই। না দিদি?

রাজলক্ষ্মী জবাব দিল না, রাগ করিয়া বাহির হইয়া গেল। বজ্রানন্দ জিজ্ঞাসা করিল, ভয়ানক রোগা দেখাচ্চে দাদা, ইতিমধ্যে কাণ্ডটা কি ঘটেছিল বলুন ত? বাড়ি না ঢুকে হঠাৎ গা-ঢাকা দিলেন কেন?

গা-ঢাকা দিবার হেতু সবিস্তারে বর্ণনা করিলাম। শুনিয়া আনন্দ কহিল, ভবিষ্যতে এরকম করে আর পালাবেন না। কিভাবে যে ওঁর দিনগুলো কেটেচে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

তাহা জানিতাম। সুতরাং চোখে না দেখিয়াও আমি বিশ্বাস করিলাম। রতন চা ও তামাক দিয়া গেল। আনন্দ কহিল, আমিও বাইরে যাই দাদা। এখন আপনার কাছে বসে থাকলে আর একজন হয়ত ইহজন্মে আমার মুখ দেখবেন না। এই বলিয়া সে হাসিয়া প্রস্থান করিল।

খানিক পরে রাজলক্ষ্মী প্রবেশ করিয়া অত্যন্ত সহজভাবে কহিল, ও ঘরে গরম জল গামছা কাপড় সমস্ত রেখে এলাম, শুধু গা-মাথা মুছে কাপড় ছেড়ে ফেল গে। জ্বরের ওপর খবরদার যেন মাথায় জল ঢেলো না বলচি।

কহিলাম, কিন্তু স্বামীজী তোমাকে ভুল বলেছে, জ্বর আমার নেই।

রাজলক্ষ্মী বলিল, না-ই থাক, কিন্তু হতে কতক্ষণ?

কহিলাম, সে খবর তোমাকে সঠিক দিতে পারব না, কিন্তু গরমে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে, স্নান করা দরকার।

রাজলক্ষ্মী কহিল, দরকার নাকি? তাহ’লে একা হয়ত পেরে উঠবে না, চল আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। এই বলিয়া সে নিজেই হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, কেন আড়ি ক’রে আমাকেও কষ্ট দেবে, নিজেও কষ্ট পাবে? এত অবেলায় নেয়ো না, লক্ষ্মীটি।

এই ধরনের কথা বলায় রাজলক্ষ্মীর জোড়া কোথাও দেখি নাই। নিজের ইচ্ছাকেই জোর করিয়া পরের স্কন্ধে চাপাইয়া দিবার কটুতাটুকু সে স্নেহের মাধুর্যরসে এমনিই ভরিয়া দিতে পারিত যে, সে জিদের বিরুদ্ধে কাহারও কোন সঙ্কল্পই মাথা তুলিতে পারিত না। এ ব্যাপারটা তুচ্ছ, স্নান না করিলেও আমার চলিয়া যাইবে, কিন্তু চলিয়া যায় না এমন ব্যাপারও বহুবার দেখিয়াছি। তাহার ইচ্ছাশক্তিকে অতিক্রম করিয়া চলিবার শক্তি শুধু কেবল আমিই পাই নাই তাহা নয়, কাহাকেও কোনদিনই খুঁজিয়া পাইতে দেখি নাই। আমাকে তুলিয়া দিয়া সে খাবার আনিতে গেল।

বলিলাম, তোমার ব্রাহ্মণভোজনের পালাটা আগে শেষ হোক না!

0 Shares