শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

সময় হইয়া আসিল, ঘোড়ার গাড়ি দ্বারের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, গুরুদেবের নিকট বিদায় লইয়া আমি গাড়িতে গিয়া বসিলাম। রাজলক্ষ্মী পথে আসিয়া গাড়ির ভিতরে হাত বাড়াইয়া বার বার করিয়া আমার পায়ের ধূলা মাথায় দিল, কিন্তু কথা কহিল না। বোধ হয় সে শক্তি তাহার ছিল না। ভালই হইল যে, অন্ধকারে সে আমার মুখ দেখিতে পাইল না। আমি স্তব্ধ হইয়া রহিলাম, কি যে বলিব, খুঁজিয়া পাইলাম না। শেষ বিদায়ের পালাটা নিঃশব্দেই সাঙ্গ হইল। গাড়ি ছাড়িয়া দিলে দুই চোখ দিয়া আমার ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। সর্বান্তঃকরণে কহিলাম, তুমি সুখী হও, শান্ত হও, তোমার লক্ষ্য ধ্রুব হোক, তোমাকে হিংসা করি না, কিন্তু যে দুর্ভাগা সমস্ত বিসর্জন দিয়া একই সাথে একদিন তরণী ভাসাইয়াছিল এ জীবনে তাহার আর কূল মিলিবে না। ঘর্‌ঘর্‌ ঝর্‌ঝর্‌ করিয়া গাড়ি চলিতে লাগিল, গঙ্গামাটির সকল স্মৃতি আলোড়িত হইয়া উঠিল। সেদিন বিদায়ের ক্ষণে যে-সকল কথা মনে আসিয়াছিল, আবার তাহাই জাগিয়া উঠিল। মনে হইল, এই যে এক জীবন-নাট্যের অত্যন্ত স্থূল এবং সাধু-উপসংহার হইল ইহার খ্যাতির আর অন্ত নাই। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করিলে ইহার অম্লান দীপ্তি কোনদিন নিবিবে না, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে মাথা নত করিবার মত পাঠকেরও কোনদিন সংসারে অভাব ঘটিবে নাকিন্তু আমার নিজের কথা কাহাকেও বলিবার নহেআমি চলিলাম অন্যত্র,আমারই মত যে কলুষের পঙ্কে মগ্ন হইয়া আছে, ভাল হইবার আর পথ নাই, সেই অভয়ার আশ্রয়ে। মনে মনে রাজলক্ষ্মীকে উদ্দেশ করিয়া কহিলাম, তোমার পুণ্যজীবন উন্নত হইতে উন্নততর হোক, তোমার মধ্য দিয়া ধর্মের মহিমা উজ্জ্বল হইতে উজ্জ্বলতর হোক, আমি আর ক্ষোভ করিব না। অভয়ার চিঠি পাইয়াছি। স্নেহে, প্রেমে, করুণায় অটল অভয়া, ভগিনীর অধিক বিদ্রোহী অভয়া আমাকে সাদরে নিমন্ত্রণ করিয়াছে। বর্মা হইতে আসিবার কালে ক্ষুদ্র দ্বারপ্রান্তে তাহার সজল চক্ষু মনে পড়িল, মনে পড়িল তাহার সমস্ত অতীত ও বর্তমান ইতিহাস। চিত্তের শুচিতায়, বুদ্ধির নির্ভয়তায় ও আত্মার স্বাধীনতায় সে যেন আমার সমস্ত দুঃখ একনিমেষে আবৃত করিয়া উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।

সহসা গাড়ি থামিতে চকিত হইয়া দেখিলাম স্টেশনে পৌঁছিয়াছি। নামিয়া দাঁড়াইতে আর এক ব্যক্তি কোচবাক্স হইতে তাড়াতাড়ি নামিয়া আমার পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল।

কে রে, রতন যে!

বাবু, বিদেশে চাকরের যদি অভাব হয় ত আমাকে একটু খবর দেবেন। যতদিন বাঁচব আপনার সেবার ত্রুটি হবে না।

গাড়ির লন্ঠনের আলো তাহার মুখের উপর পড়িয়াছিল, বিস্মিত হইয়া বলিলাম, তুই কাঁদচিস্‌ কেন বল্‌ ত?

রতন জবাব দিল না, হাত দিয়া চোখ মুছিয়া পায়ের কাছে আর একবার ঢিপ করিয়া নমস্কার করিয়াই দ্রুতবেগে অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেল।

আশ্চর্য, এই সেই রতন!

(সমাপ্ত)

0 Shares