শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

আমার মনে পড়িল, এ-বাড়ি সে বঙ্কুকে দান করিয়াছে। কহিলাম, কিন্তু ধর যদি সে-জায়গা তোমার বেশিদিন ভাল না লাগে?

রাজলক্ষ্মী একটুখানি হাসিয়া কহিল, আমার জন্যে তোমার মন খারাপ করবার দরকার নেই। তোমার ভাল না লাগলে চলে এসো, আমি তাতে বাধা দেব না।

তাহার কথার ভঙ্গিতে আমি আঘাত পাইয়া চুপ করিলাম। এটা আমি বহুবার দেখিয়াছি, সে আমার এই ধরনের কোন প্রশ্নই যেন সরলচিত্তে গ্রহণ করিতে পারে না। আমিও যে তাহাকে অকপটে ভালবাসিতে পারি, কিংবা তাহার সংস্রবে স্থির হইয়া বাস করিতে পারি, ইহা কিছুতেই যেন তাহার মনের সঙ্গে গাঁথিয়া এক হইয়া উঠিতে চাহে না। সংশয়ের আলোড়নে অবিশ্বাস এক মুহূর্তেই এমন উগ্র হইয়া বাহিরে আসে যে, তাহার জ্বালা বহুক্ষণ অবধি উভয়ের মনেই রি-রি করিয়া জ্বলিতে থাকে। এই অবিশ্বাসের আগুন যে কবে নিবিবে এবং কেমন করিয়া নিবিবে, আমি তাহার কোন কিনারাই ভাবিয়া পাই না। সেও ইহারই সন্ধানে অবিশ্রাম ঘুরিতেছে—এবং গঙ্গামাটি এ সমস্যার শেষ মীমাংসা করিয়া দিবে কি না, সে তথ্য যাঁহার হাতে তিনি অলক্ষ্যে চুপ করিয়াই আছেন।

সর্ববিধ আয়োজনে আরও দিন-চারেক কাটিল এবং আরও দিন-দুই গেল শুভক্ষণের প্রতীক্ষায়। তার পরে একদিন সকালে অপরিচিত গঙ্গামাটির উদ্দেশে আমরা সত্য সত্যই যাত্রা করিয়া বাহির হইয়া পড়িলাম। পথটা আমার ভাল কাটিল না—মনে কিছুমাত্র সুখ ছিল না। আর সকলের চেয়ে খারাপ কাটিল বোধ করি রতনের। সে মুখখানা অসম্ভব ভারী করিয়া গাড়ির এককোণে চুপচাপ বসিয়া রহিল; স্টেশনের পর স্টেশন গেল, কোন কাজে কিছুমাত্র সাহায্য করিল না। কিন্তু আমি ভাবিতেছিলাম সম্পূর্ণ অন্য কথা। স্থানটা জানা কি অজানা, ভাল কি মন্দ, স্বাস্থ্যকর কি ম্যালেরিয়ায় ভরা, সেদিকে আমার খেয়ালই ছিল না; আমি ভাবিতেছিলাম, যদিচ জীবনটা আমার এতদিন নিরুপদ্রবে কাটে নাই, ইহার মধ্যে অনেক গলদ, অনেক ভুলচুক, অনেক দুঃখ-দৈন্যই গিয়াছে, তবুও সে-সব আমার অত্যন্ত পরিচিত। এই দীর্ঘ দিনে তাহাদের সহিত মোকাবিলা ত বটেই, বরঞ্চ এক প্রকারের স্নেহই জন্মিয়া গেছে। তাহাদের জন্য আমিও কাহাকে দোষ দিই না, আমাকেও আর বড় কেহ দোষ দিয়া সময় নষ্ট করে না। কিন্তু এই যে কোথায় কি-একটা নূতনত্বের মধ্যে নিশ্চিত চলিয়াছি, এই নিশ্চয়তাই আমাকে বিকল করিয়াছে।

আজ নয় কাল বলিয়া আর দেরি করিবার রাস্তা নাই। অথচ ইহার না জানি ভাল, না জানি মন্দ। তাই ইহার ভাল-মন্দ কোনটাই আজ আর কোনমতেই ভাল লাগে না। গাড়ি যতই দ্রুতবেগে গন্তব্য স্থানের নিকটবর্তী হইতে চলিয়াছে ততই এই অজ্ঞাত রহস্যের বোঝা আমার বুকের উপর চাপিয়া বসিতেছে, কত কি যে মনে হইতে লাগিল তাহার অবধি নাই। মনে হইল, অচির ভবিষ্যতে হয়ত আমাকেই কেন্দ্র করিয়া একটা বিশ্রী দল গড়িয়া উঠিবে, তাহাদের না পারিব লইতে, না পারিব ফেলিতে। তখন কি যে হইবে, আর কি যে হইবে না, ভাবিতেও সমস্ত মনটা যেন হিম হইয়া উঠিল। চাহিয়া দেখিলাম, রাজলক্ষ্মী জানালার বাহিরে দু’চক্ষু মেলিয়া নীরবে বসিয়া আছে। সহসা মনে হইল, ইহাকে আমি কোনদিন ভালবাসি নাই। তবু ইহাকে আমার ভালবাসিতেই হইবে; কোথাও কোনদিকে বাহির হইবার পথ নাই। পৃথিবীতে এত বড় বিড়ম্বনা কি কখনো কাহারো ভাগ্যে ঘটিয়াছে! অথচ একটা দিন পূর্বেও এই দ্বিধার যাঁতাকল হইতে আত্মরক্ষা করিতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উহারই হস্তে আত্মসমর্পণ করিয়াছিলাম। তখন মনে মনে সবলে বলিয়াছিলাম, তোমার সকল ভাল-মন্দের সঙ্গেই তোমাকে নিলাম লক্ষ্মী। অথচ আজ আমার মন এমন বিক্ষিপ্ত, এমন বিদ্রোহী হইয়া উঠিল! তাই ভাবি, সংসারে করিব বলায় এবং সত্যকার করায় কত বড়ই না ব্যবধান!

পরিচ্ছেদ – তিন

সাঁইথিয়া স্টেশনে আসিয়া যখন পৌঁছান গেল তখন বেলা পড়িয়া আসিতেছে। রাজলক্ষ্মীর গোমস্তা কাশীরাম স্বয়ং স্টেশনে আসিতে পারেন নাই—সেদিকের ব্যবস্থা করিতে নিযুক্ত আছেন, কিন্তু জন-দুই লোক পাঠাইয়া পত্র দিয়াছেন। তাঁহার রোকায় অবগত হওয়া গেল যে, ঈশ্বরেচ্ছায় ‘অত্র’ অর্থাৎ তিনি এবং তাঁহার গঙ্গামাটির সমস্ত কুশল। আদেশমত বাহিরে খানচারেক গো-যান অপেক্ষা করিতেছে—তাহার দুইখানি খোলা এবং দুইখানি ছই-দেওয়া। একখানিতে পুরু করিয়া খড়, আর খেজুরপাতার চাটাই বিছান—সেখানি স্বয়ং কর্ত্রীঠাকুরানীর। অপরখানিতে সামান্য কিছু খড় আছে বটে, কিন্তু চাটাই নাই। সেখানে ভৃত্যাদি অনুচরগণের জন্য। খোলা দুইখানিতে মালপত্র বোঝাই হইবে। এবং যদ্যপি স্থানসঙ্কুলান না হয় ত পাইকদিগকে হুকুম করিলে বাজার হইতে আরও একটা যোগাড় করিয়া আনিবে। তিনি আরও জানাইয়াছেন যে, আহারাদি সমাপনপূর্বক সন্ধ্যার প্রাক্কালে যাত্রা করাই বিধেয়। কারণ অন্যথা কর্ত্রীঠাকুরানীর সুনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিতে পারে। এবং এ বিষয়ে সবিশেষ জ্ঞাত করাইতেছেন যে, পথে ভয়াদি কিছু নাই—স্বচ্ছন্দে নিদ্রা যাইতে পারেন।

কর্ত্রীঠাকুরানী রোকা পাঠ করিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন মাত্র, এবং যে ইহা দিল তাহাকে ভয়াদির কোন প্রশ্ন না করিয়া কেবল প্রশ্ন করিলেন, হাঁ বাবা, কাছাকাছি একটা পুকুর-টুকুর আছে দেখিয়ে দিতে পার, একটা ডুব দিয়ে আসি?

আছে বৈ কি মাঠান্‌। উই যে হোথাকে—

তা হলে চল ত বাবা দেখিয়ে দেবে; বলিয়া সে তাহাকে এবং রতনকে সঙ্গে লইয়া কোথাকার কোন্‌ অজানা পুকুরে স্নানাহ্নিক করিতে চলিয়া গেল। অসুখ প্রভৃতির ভয় দেখান নিরর্থক বলিয়া আমি প্রতিবাদও করিলাম না। বিশেষতঃ ইহাতেই যদি বা সে কিছু খায়, বাধা দিলে সেটাও তাহার আজিকার মত বন্ধ হইয়া যাইবে।

কিন্তু আজ সে মিনিট-দশেকের মধ্যেই ফিরিয়া আসিল। গরুর গাড়িতে জিনিসপত্র বোঝাই চলিতেছিল, সামান্য দুই-একটা বিছানা খুলিয়া গাড়িতে পাতা হইতেছে। আমাকে সে কহিল, তুমি কেন এইবেলা কিছু খেয়ে নাও না? সমস্তই ত আনা হয়েচে।

0 Shares