শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব

বলিলাম, দাও।

গাছতলায় আসন পাতিয়া একটা কলাপাতে সে সমস্ত গুছাইয়া দিতেছে, আমি নিস্পৃহচিত্তে কেবলমাত্র তাহার প্রতি চাহিয়া আছি, এমন সময় এক মূর্তি আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া হাঁকিল, নারায়ণ!

রাজলক্ষ্মী তাহার ঝুঁটি-করা ভিজে চুলের উপর বাঁ হাতের পিছন দিয়া আঁচলটা আর একটুখানি টানিয়া দিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল। কহিল, আসুন।

অকস্মাৎ এই নিঃসঙ্কোচ নিমন্ত্রণের শব্দে মুখ ফিরাইয়া দেখিলাম এক সাধু দাঁড়াইয়া। অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম। তাহার বয়স বেশি নয়, বোধ হয় কুড়ি-একুশের মধ্যে, কিন্তু যেমন সুকুমার তেমনি সুশ্রী। চেহারাটা কৃশতার দিকেই—হয়ত একটু দীর্ঘকায় বলিয়াই মনে হইল, কিন্তু রঙ তপ্তকাঞ্চনের ন্যায়। চোখ, মুখ, ভ্রূ ও কপালের গঠন নিখুঁত বলিলেই হয়। বাস্তবিক, পুরুষের এত রূপ আর আমি কখনো দেখিয়াছি বলিয়া মনে হইল না।

তাহার পরিধানে গেরুয়া বস্ত্রখানি স্থানে স্থানে ছিন্ন—গ্রন্থিবাঁধা। গায়ের গেরুয়া পাঞ্জাবীরও যেমন জীর্ণ দশা, পায়ের পাঞ্জাবী জুতাজোড়াটিও প্রায় তদ্রূপ; হারাইলে দুঃখ করিবার বিশেষ কিছু নাই। রাজলক্ষ্মী ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া আসন পাতিয়া দিল। মুখ তুলিয়া কহিল, আমি ততক্ষণ খাবার ঠিক করি, আপনাকে মুখ-হাত ধোবার জল দিক?

সাধু কহিলেন, তা দিক, কিন্তু আপনার কাছে আমি অন্য প্রয়োজনে এসেছিলাম।

রাজলক্ষ্মী বলিল, আচ্ছা, আপনি খেতে বসুন, সে পরে হবে এখন। বাড়ি ফেরবার টিকিট চাই ত? সে আমি কিনে দেব। বলিয়া সে মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিল।

সাধুজী গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন, না, সে প্রয়োজন নেই। আমি খবর নিয়েচি আপনারা গঙ্গামাটি যাচ্চেন। আমার সঙ্গে একটা ভারী বাক্স আছে, সেটা যদি কতকটা পথ আপনাদের গাড়িতে তুলে নেন। আমিও ওই দিকেই যাচ্চি।

রাজলক্ষ্মী কহিল, সে আর বেশি কথা কি! কিন্তু আপনি নিজে?

আমি হেঁটেই যেতে পারব। বেশি দূর নয়, ক্রোশ ছয়-সাত হবে।

রাজলক্ষ্মী আর কিছু না বলিয়া রতনকে ডাকিয়া জল দিতে বলিল, এবং নিজে পরিপাটি করিয়া সাধুজীর খাবার সাজাইতে নিযুক্ত হইল। এই কাজটি রাজলক্ষ্মীর নিজস্ব বস্তু, ইহাতে তাহার জোড়া পাওয়া ভার।

সাধু খাইতে বসিলেন, আমিও বসিলাম। রাজলক্ষ্মী খাবারের হাঁড়ি লইয়া পাশেই রহিল। মিনিট-দুই পরে রাজলক্ষ্মী আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, সাধুজী, আপনার নামটি?

সাধু খাইতে খাইতে কহিলেন, বজ্রানন্দ।

রাজলক্ষ্মী কহিল, বাপ্‌ রে বাপ্‌! ডাকনামটি?

তাহার কথার ধরনে চাহিয়া দেখিলাম তাহার সমস্ত মুখখানি চাপা হাসির ছটায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু সে হাসিল না, আমিও আহারে মন দিলাম। সাধুজী বলিলেন, সে নামের সঙ্গে আর ত কোন সম্বন্ধ নেই—নিজেরও না, পরেরও না।

রাজলক্ষ্মী সহজেই সায় দিয়া কহিল, তা বটে! কিন্তু মুহূর্তকাল পরেই প্রশ্ন করিল, আচ্ছা সাধুজী, আপনি বাড়ি থেকে পালিয়েছেন কত দিন?

প্রশ্নটি অত্যন্ত অভদ্র। চাহিয়া দেখিলাম, রাজলক্ষ্মীর মুখে হাসি নাই বটে, কিন্তু যে পিয়ারীর মুখখানি আমি প্রায় ভুলিয়া গিয়াছিলাম, এখন রাজলক্ষ্মীর প্রতি চাহিয়া চক্ষের নিমিষে আবার তাহাকেই মনে পড়িয়া গেল। সেই পুরানো দিনের সমস্ত সরসতা তাহার চোখে-মুখে কণ্ঠস্বরে যেন সজীব হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে।

সাধু একটা ঢোক গিলিয়া কহিলেন, আপনার এ কৌতূহল সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।

রাজলক্ষ্মী লেশমাত্র ক্ষুণ্ণ হইল না, ভালমানুষটির মত মাথা নাড়িয়া কহিল, তা সত্যি। তবে একবার নাকি ভারি ভুগতে হয়েছে তাই—এই বলিয়া সে আমাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, হাঁ গা, বল ত তোমার সেই উট আর টাট্টুঘোড়ার গল্পটি? সাধুজীকে একবার শুনিয়ে দাও ত—আহা হা! ষাট্‌ ষাট্‌! কে বুঝি বাড়িতে নাম করচে।

সাধুজী বোধ হয় হাসি চাপিতে গিয়াই একটা বিষম খাইলেন। এতক্ষণ আমার সঙ্গে একটা কথাও হয় নাই, কর্ত্রীঠাকুরানীর আড়ালে কতকটা অনুচরের মতই ছিলাম। এখন সাধুজী বিষম সামলাইয়া যথাসম্ভব গাম্ভীর্যের সহিত আমাকে প্রশ্ন করিলেন, আপনি বুঝি তা হলে একবার সন্ন্যাসী—

আমার মুখে লুচি ছিল, বেশি কথার জো ছিল না, তাই ডান হাতের চারটা আঙ্গুল তুলিয়া ধরিয়া ঘাড় নাড়িয়া জানাইলাম—উহুঁ হুঁ—একবার নয়, একবার নয়—

এবার সাধুজীর গাম্ভীর্য আর বজায় রহিল না, সে এবং রাজলক্ষ্মী দু’জনেই খিল-খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসি থামিলে সাধু কহিলেন, ফিরলেন কেন?

লুচির ডেলাটা তখনও গিলিতে পারি নাই, শুধু রাজলক্ষ্মীকে দেখাইয়া দিলাম।

রাজলক্ষ্মী তর্জন করিয়া উঠিল, বলিল, তাই বৈ কি! আচ্ছা, একবার নাহয় আমারি জন্যে—তাও ঠিক সত্যি নয়—আসলে ভয়ানক অসুখে পড়েই—কিন্তু আর তিনবার?

কহিলাম, সেও প্রায় কাছাকাছি—মশার কামড়ে। ওটা কিছুতেই চামড়ায় সইল না।আচ্ছা—

সাধু হাসিয়া কহিলেন, আমাকে আপনি বজ্রানন্দ বলেই ডাকবেন। আপনার নামটি—

আমার পূর্বেই রাজলক্ষ্মী জবাব দিল। কহিল, ওঁর নামে কি হবে? উনি বয়সে অনেক বড়, ওঁকে দাদা বলেই ডাকবেন। আর আমাকেও বৌদিদি বলে ডাকলে রাগ করব না। আর আমি কোন না বয়সে তোমার বছর-পাঁচেকের বড় হব!

সাধুজীর মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। আমিও এতটা প্রত্যাশা করি নাই। বিস্ময়ে চাহিয়া দেখিলাম—এ সেই পিয়ারী। সেই স্বচ্ছ, সহজ স্নেহাতুরা আনন্দময়ী ! সেই যে আমাকে কোনমতেই শ্মশানে যাইতে দিতে চাহে নাই, এবং কিছুতেই রাজসংসর্গে টিকিতে দিল না—এ সেই। এই যে ছেলেটি তাহার কোথাকার স্নেহের বাঁধন ছিন্ন করিয়া আসিয়াছে—সেখানকার সমস্ত অজানা বেদনা রাজলক্ষ্মীর বুক জুড়িয়া টান ধরিয়াছে। কোনমতে ইহাকে সে আবার গৃহে ফিরাইয়া আনিতে চায়।

সাধু বেচারা লজ্জার ধাক্কাটা সামলাইয়া লইয়া কহিল, দেখুন, দাদা বলতে আমার তত আপত্তি নেই, কিন্তু আমাদের সন্ন্যাসীদের ও-সব বলে ডাকতে নেই।

0 Shares