স্বামী

আমি মানুষের এই বড় একটা অদ্ভুত কাণ্ড দেখি যে, যে বিপদটা হঠাৎ তার ঘাড়ে এসে পড়ে তাকে একান্ত অস্থির ও উদ্বিগ্ন করে দিয়ে যায়, অনেক সময়ে সে তাকেই একপাশে ঠেলে দিয়ে একটা তুচ্ছ কথা চিন্তা করতে বসে যায়। বাইরে পান পাঠিয়ে দিয়ে আমি নরেনের কথাই ভাবতে বসেছিলুম সত্যি, কিন্তু কখন কোন্‌ ফাঁকে যে আমার স্বামী এসে আমার সমস্ত মন জুড়ে বসে গিয়েছিলেন, সে আমি টেরও পাইনি।

আমার স্বামীকে আমি যত দেখছিলুম ততই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলুম। সবচেয়ে আশ্চর্য হ’তুম—তাঁর ক্ষমা করবার ক্ষমতা দেখে। আগে আগে মনে হ’ত, এ তাঁর দুর্বলতা, পুরুষত্বের অভাব। শাসন করবার সাধ্য নেই বলেই ক্ষমা করেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছিল, ততই টের পাচ্ছিলুম তিনি যেমন বুদ্ধিমান তেমনি দৃঢ়। আমাকে যে তিনি ভেতরে ভেতরে কত ভালবেসেচেন, সে ত আমি অসংশয়ে অনুভব করতে পারি, কিন্তু সে ভালবাসার ওপর এতটুকু জোর খাটাবার সাহস আমার ত হয় না।

একদিন কথায় কথায় বলেছিলুম, আচ্ছা, তুমিই বাড়ির সর্বস্ব, কিন্তু তোমাকে যে বাড়িসুদ্ধ সবাই অযত্নঅবহেলা করে, এমন কি অত্যাচার করে, এ কি তুমি ইচ্ছা করলে শাসন করে দিতে পার না?

তিনি হেসে জবাব দিয়েছিলেন, কৈ, কেউ ত অযত্ন করে না!

কিন্তু আমি নিশ্চয় জানতুম, কিছুই তাঁর অবিদিত ছিল না। বললুম, আচ্ছা, যত বড় দোষই হোক, তুমি কি সব মাপ করতে পার?

তিনি তেমনি হাসিমুখে বললেন, যে সত্যি ক্ষমা চায়, তাকে করতেই হবে, এ যে আমাদের মহাপ্রভুর আদেশ গো!

তাই এক-একদিন চুপ করে বসে ভাবতুম, ভগবান যদি সত্যি নেই, তা হলে এত শক্তি, এত শান্তি ইনি পেলেন কোথায়? এই যে আমি স্ত্রীর কর্তব্য একদিনের জন্যে করিনে, তবু ত তিনি কোনদিন স্বামীর জোর নিয়ে আমায় অমর্যাদা অপমান করেন না!

আমাদের ঘরের কুলুঙ্গিতে একটি শ্বেত-পাথরের গৌরাঙ্গমূর্তি ছিল, আমি কত রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে দেখেচি, স্বামী বিছানার উপর স্তব্ধ হয়ে বসে একদৃষ্টে তাঁর পানে চেয়ে আছেন, আর দু’চক্ষু বয়ে অশ্রুর ধারা বয়ে যাচ্ছে। সময়ে সময়ে তাঁর মুখ দেখে আমারও যেন কান্না আসত, মনে হত, অমনি করে একটা দিনও কাঁদতে পারলে বুঝি মনের অর্ধেক বেদনা কমে যাবে। পাশের কুলুঙ্গিতে তাঁর খান-কয়েক বড় আদরের বই ছিল, তাঁর দেখাদেখি আমিও মাঝে মাঝে পড়তুম। লেখাগুলো যে আমি সত্যি বলে বিশ্বাস করতুম, তা নয়, তবুও এমন কতদিন হয়েচে, কখন পড়ায় মন লেগে গেছে, কখন বেলা বয়ে গেছে, কখন দু’ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে গালের উপর শুকিয়ে আছে, কিছুই ঠাওর পাইনি। কতদিন হিংসে পর্যন্ত হয়েছে, তাঁর মত আমিও যদি এগুলি সমস্ত সত্যি বলেই ভাবতে পারতুম!

কিছুদিন থেকে আমি বেশ টের পেতুম, কি একটা ব্যথা যেন প্রতিদিনই আমার বুকের মধ্যে জমা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কেন, কিসের জন্যে, তা কিছুতে হাতড়ে পেতুম না। শুধু মনে হ’ত আমার যেন কেউ কোথাও নেই। ভাবতুম, মায়ের জন্যেই বুঝি ভেতরে ভেতরে মন কেমন করে, তাই কতদিন ঠিক করেচি, কালই পাঠিয়ে দিতে বলব, কিন্তু যেই মনে হ’ত, এই ঘরটি ছেড়ে আর কোথাও যাচ্ছি, না—অমনি সমস্ত সঙ্কল্প কোথায় যে ভেসে যেত, তাঁকে মুখ ফুটে বলাও হ’ত না।

মনে করলুম, যাই, কুলুঙ্গি থেকে বইখানা এনে একটু পড়ি। আজকাল এই বইখানা হয়েছিল আমার অনেক দুঃখের সান্ত্বনা। কিন্তু উঠতে গিয়ে হঠাৎ আঁচলে একটা টান পড়তেই ফিরে চেয়ে নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস হ’ল না। দেখি, আমার আঁচল ধরে জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে নরেন। একটু হলেই চেঁচিয়ে ফেলেছিলুম আর কি! সে কখন এসেচে, কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কিছুই জানতে পারিনি। কিন্তু কি করে যে সেদিন আপনাকে সামলে ফেলেছিলুম, আমি আজও ভেবে পাইনে। ফিরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলুম, এখানে এসেচ কেন? শিকার করতে?

নরেন বললে, বস বলচি।

আমি জানালার ওপর বসে পড়ে বললুম, শিকার করতে যাওনি কেন?

নরেন বললে, ঘনশ্যামবাবুর হুকুম পাইনি। যাবার সময় বলে গেলেন, আমরা বৈষ্ণব, আমাদের বাড়ি থেকে জীবহত্যা করা নিষেধ।

চক্ষের নিমেষে স্বামী-গর্বে আমার বুকখানা ফুলে উঠল। তিনি কোন কর্তব্য ভোলেন না, সেদিকে তাঁর একবিন্দু দুর্বলতা নেই। মনে মনে ভাবলুম, এ লোকটা দেখে যাক আমার স্বামী কত বড়!

বললুম, তা হলে বাড়ি ফিরে গেলে না কেন?

সে লোকটা গরাদের ফাঁক দিয়ে খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরে বললে, সদু, টাইফয়েড জ্বরে মরতে মরতে বেঁচে উঠে যখন শুনলুম তুমি পরের হয়েচ, আর আমার নেই, তখন বার বার করে বললুম, ভগবান, আমাকে বাঁচালে কেন? তোমার কাছে আমি এইটুকু বয়সের মধ্যে এমন কি পাপ করেচি, যার শাস্তি দেবার জন্যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে!

বললুম, তুমি ভগবান মান?

নরেন থতমত খেয়ে বলতে লাগল, না হাঁ, না, মানিনে, কিন্তু সে সময়ে—কি জান!

থাক গে, তার পরে?

নরেন বলে উঠল, উঃ, সে আমার কি দিন, যেদিন শুনলুম, তুমি আমারই আছ, শুধু নামে অন্যের, নইলে আমারই চিরকাল, শুধু আমারই! আজও একদিনের জন্য আর কারও শয্যায় রাত্রি—

ছি ছি, চুপ কর। কিন্তু কে তোমাকে এ খবর দিলে? কার কাছে শুনলে?

তোমাদের যে দাসী তিন-চারদিন হল বাড়ি যাবার নাম করে চলে গেছে, যে—

মুক্ত কি তোমার লোক ছিল? বলে জোর করে তার হাত ছাড়াতে গেলুম, কিন্তু এবারেও সে তেমনি সজোরে ধরে রাখলে। তার চোখ দিয়ে ফোঁটা-দুই জলও গড়িয়ে পড়ল। বললে, সদু, এমনি করেই কি আমাদের জীবনের শেষ হবে? অমন অসুখে না পড়লে আজ কেউ ত আমাদের আলাদা করে রাখতে পারত না! যে অপরাধ আমার নিজের নয়, তার জন্য কেন এতবড় শাস্তি ভোগ করব? লোকে ভগবান ভগবান করে, কিন্তু তিনি সত্যি থাকলে কি বিনাদোষে এতবড় সাজা আমাদের দিতেন? কখন না। তুমিই বা কিসের জন্য একজন অজানা-অচেনা মুখ্যু-লোকের—

থাক, থাক, ও-কথা থাক।

নরেন চমকে উঠে বললে, আচ্ছা থাক, কিন্তু যদি জানতুম, তুমি সুখে আছ, সুখী হয়েচ, তা হলে হয়ত একদিন মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতুম, কিন্তু কোন সম্বলই যে আমার হাতে নেই, আমি বাঁচব কি করে?

আবার তার চোখে জল এসে পড়ল। এবার সে আমার হাতটাই টেনে নিয়ে তার নিজের চোখের জল মুছে বললে, এমন কোন সভ্য দেশ পৃথিবীতে আছে—যেখানে এতবড় অন্যায় হতে পারত! মেয়েমানুষ বলে কি তার প্রাণ নেই, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে এমন করে তাকে সারাজীবন দগ্ধ করবার অধিকার সংসারে কার আছে? কোন্‌ দেশের মেয়েরা ইচ্ছে করলে এমন বিয়ে লাথি মেরে ভেঙ্গে দিয়ে যেখানে খুশি চলে যেতে না পারে?

এসব কথা আমি সমস্তই জানতুম! আমার মামার ঘরে নব্য-যুগের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার কোন আলোচনাই বাকী ছিল না। আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন দুলতে লাগল। বললুম, তুমি আমাকে কি করতে বল?

নরেন বললে, আমি তোমাকে কোন কথাই বলব না। এইটুকু শুধু জানিয়ে যাব যে, মরণের গ্রাস থেকে উঠে পর্যন্ত আমি এই আজকের দিনের প্রতীক্ষা করেই পথ চেয়েছিলুম। তার পরে হয়ত একদিন শুনতে পাবে, যেখান থেকে উঠে এসেচি, তার কাছেই ফিরে চলে গেছি। কিন্তু তোমার কাছে এই আমার শেষ নিবেদন রইল সদু, বেঁচে থাকতে যখন কিছুই পেলুম না, মরণের পরে যেন ঐ চোখের দু’ফোঁটা জল পাই। আত্মা বলে যদি কিছু থাকে, তার তাতেই তৃপ্তি হবে।

0 Shares