হরিলক্ষ্মী

শিবচরণ কহিল, কাজ ? আরে, ওদের দাসী আছে, না চাকর আছে ? বাসনমাজা থেকে হাঁড়ি-ঠেলা পর্যন্ত—কৈ, তোমার মত শুয়ে-বসে গায়ে ফুঁ দিয়ে কাটাক ত দেখি? এক ঘটি জল পর্যন্ত আর তোমাকে গড়িয়ে খেতে হয় না।

নিজের সম্বন্ধে এইরূপ মন্তব্য হরিলক্ষ্মীর অত্যন্ত খারাপ লাগিল, কিন্তু কথাগুলা নাকি তাহাকে বাড়াইবার জন্যই, লাঞ্ছনার জন্য নহে, এই মনে করিয়া সে রাগ করিল না, বলিল, শুনেছি নাকি মেজবৌর বড় গুমোর, বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায় না ?

শিবচরণ কহিল, যাবে কোত্থেকে ? হাতে ক’গাছি চুড়ি ছাড়া আর ছাইও নেই,—লজ্জায় মুখ দেখাতে পারে না।

হরিলক্ষ্মী একটুখানি হাসিয়া বলিল, লজ্জা কিসের? দেশের লোক কি ওঁর গায়ে জড়োয়া গয়না দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে, না, দেখতে না পেলে ছি ছি করে?

শিবচরণ কহিল, জড়োয়া গহনা ! আমি যা তোমাকে দিয়েছি, কোন শালার বেটা তা চোখে দেখেছে? পরিবারকে আজ পর্যন্ত দু’গাছা চুড়ি ছাড়া আর গড়িয়ে দিতে পারলি নে! বাবা! টাকার জোর বড় জোর! জুতো মারব আর—

হরিলক্ষ্মী ক্ষুণ্ণ ও অতিশয় লজ্জিত হইয়া বলিল, ছি ছি, ও-সব তুমি কি বলছ?

শিবচরণ কহিল, না না, আমার কাছে লুকোছাপা নেই—যা বলব, তা স্পষ্টাস্পষ্টি কথা।

হরিলক্ষ্মী নিরুত্তরে চোখ বুজিয়া শুইল। বলবারই বা আছে কি ? ইহারা দুর্বলের বিরুদ্ধে অত্যন্ত রূঢ় কথা কঠোর ও কর্কশ করিয়া উচ্চারণ করাকেই একমাত্র স্পষ্টবাদিতা বলিয়া জানে। শিবচরণ শান্ত হইল না, বলিতে লাগিল, বিয়েতে যে পাঁচ শ’ টাকা ধার নিয়ে গেলি, সুদে-আসলে সাত-আট শ’ হয়েছে, তা খেয়াল আছে ? গরীব একধারে পড়ে আছিস থাক, ইচ্ছে করলে যে কান মলে দূর করে দিতে পারি। দাসীর যোগ্য নয়,—আমার পরিবারের কাছে গুমোর!

হরিলক্ষ্মী পাশ ফিরিয়া শুইল। অসুখের উপর বিরক্তি ও লজ্জায় তাহার সর্বশরীর যেন ঝিমঝিম করিতে লাগিল।

পরদিন দুপুরবেলায় ঘরের মধ্যে মৃদুশব্দে হরিলক্ষ্মী চোখ চাহিয়া দেখিল, বিপিনের স্ত্রী বাহির হইয়া যাইতেছে। ডাকিয়া কহিল, মেজবৌ, চলে যাচ্চো যে ?

মেজবৌ সলজ্জে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আমি ভেবেছিলাম, আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আজ কেমন আছেন দিদি ?

হরিলক্ষ্মী কহিল, আজ ঢের ভাল আছি, কৈ তোমার ছেলেকে আননি ?

মেজবৌ বলিল, আজ সে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল দিদি।

হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল মানে কি ?

অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে বলে আমি দিনের বেলায় বড় তাকে ঘুমোতে দিইনে দিদি।

হরিলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিল, রোদে রোদে দুরন্তপনা করে বেড়ায় না ?

মেজবৌ কহিল, করে বৈ কি। কিন্তু ঘুমোনোর চেয়ে সে বরঞ্চ ভাল।

তুমি নিজে বুঝি কখনো ঘুমোও না ?

মেজবৌ হাসিমুখে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

হরিলক্ষ্মী ভাবিয়াছিল, মেয়েদের স্বভাবের মত এবার হয়ত সে তাহার অনবকাশের দীর্ঘ তালিকা দিতে বসিবে, কিন্তু সে সেরূপ কিছুই করিল না। ইহার পরে অন্যান্য কথাবার্তা চলিতে লাগিল। কথায় কথায় হরিলক্ষ্মী তাহার বাপের বাড়ির কথা, ভাই-বোনের কথা, মাস্টারমশায়ের কথা, স্কুলের কথা, এমনকি তাহার ম্যাট্রিক পাস করার কথাও গল্প করিয়া ফেলিল। অনেকক্ষণ পরে যখন হুঁশ হইল তখন স্পষ্ট দেখিতে পাইল, শ্রোতা হিসাবে মেজবৌ যত ভালই হউক, বক্তা হিসাবে একেবারে অকিঞ্চিৎকর। নিজের কথা সে প্রায় কিছুই বলে নাই। প্রথমটা লক্ষ্মী লজ্জা বোধ করিল, কিন্তু তখনই মনে করিল, আমার কাছে গল্প করিবার মত তাহার আছেই বা কি! কিন্তু কাল যেমন এই বধূটির বিরুদ্ধে মন তাহার অপ্রসন্ন হইয়া উঠিয়াছিল, আজ তেমনি ভারী একটা তৃপ্তি বোধ করিল।

দেয়ালের মূল্যবান ঘড়িতে নানাবিধ বাজনা-বাদ্য করিয়া তিনটা বাজিল। মেজবৌ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সবিনয়ে কহিল, দিদি, আজ তা হলে আসি ?

লক্ষ্মী সকৌতুকে বলিল, তোমার বুঝি ভাই তিনটে পর্যন্তই ছুটি? ঠাকুরপো না কি কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি মিলিয়ে বাড়ি ঢোকেন ?

মেজবৌ কহিল, আজ তিনি বাড়িতে আছেন।

আজ কেন তবে আর একটু ব’সো না ?

মেজবৌ বসিল না, কিন্তু যাবার জন্যও পা বাড়াইল না। আস্তে আস্তে বলিল, দিদি, আপনার কত শিক্ষা-দীক্ষা, কত লেখাপড়া, আমি পাড়াগাঁয়ের—

তোমার বাপের বাড়ি বুঝি পাড়াগাঁয়ে ?

হাঁ দিদি, সে একেবারে অজ পল্লীগ্রামে। না বুঝে কাল হয়ত কি বলতে কি বলে ফেলেছি, কিন্তু অসম্মান করার জন্যে,—আপনি যে দিব্যি করতে বলবেন, দিদি—

হরিলক্ষ্মী আশ্চর্য হইয়া কহিল, সে কি মেজবৌ, তুমি ত আমাকে এমন কোন কথাই বলনি !

মেজবৌ এ কথার প্রত্যুত্তরে আর একটা কথাও কহিল না। কিন্তু ‘আসি’ বলিয়া পুনশ্চ বিদায় লইয়া যখন সে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল, তখন কণ্ঠস্বর যেন তাহার অকস্মাৎ আর একরকম শুনাইল।

রাত্রিতে শিবচরণ যখন কক্ষে প্রবেশ করিল তখন হরিলক্ষ্মী চুপ করিয়া শুইয়া ছিল, মেজবৌয়ের শেষের কথাগুলো আর তাহার স্মরণ ছিল না। দেহ অপেক্ষাকৃত সুস্থ, মনও শান্ত প্রসন্ন ছিল।

শিবচরণ জিজ্ঞাসা করিল, কেমন আছ বড়বৌ ?

লক্ষ্মী উঠিয়া বসিয়া কহিল, ভাল আছি।

শিবচরণ কহিল, সকালের ব্যাপার জান ত ? বাছাধনকে ডাকিয়ে এনে সক্কলের সামনে এমনি কড়কে দিয়েছি যে, জন্মে ভুলবে না। আমি বেলপুরের শিবচরণ! হাঁ !

হরিলক্ষ্মী ভীত হইয়া কহিল, কাকে গো ?

শিবচরণ কহিল, বিপ্‌নেকে। ডেকে বলে দিলাম, তোমার পরিবার আমার পরিবারের কাছে জাঁক করে তাকে অপমান করে যায়, এত বড় আস্পর্ধা ! পাজী, নচ্ছার, ছোটলোকের মেয়ে! তাঁর ন্যাড়া মাথায় ঘোল ঢেলে গাধায় চড়িয়ে গাঁয়ের বার করে দিতে পারি, জানিস ?

হরিলক্ষ্মীর রোগক্লিষ্ট মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হইয়া গেল,—বল কি গো ?

শিবচরণ নিজের বুকে তাল ঠুকিয়া সদর্পে বলিতে লাগিল, এ গাঁয়ে জজ বল, ম্যাজিস্ট্রেট বল, আর দারোগা পুলিশ বল, সব এই শর্মা! এই শর্মা ! মরণ-কাঠি, জীয়ন-কাঠি এই হাতে। তুমি বল, কাল যদি না বিপ্‌নের বৌ এসে তোমার পা টেপে ত আমি লাটু চৌধুরীর ছেলেই নই ! আমি—

বিপিনের বধূকে সর্বসমক্ষে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করিবার বিবরণ ও ব্যাখ্যায় লাটু চৌধুরীর ছেলে অ-কথা কু-কথার আর শেষ রাখিল না। আর তাহারই সম্মুখে স্তব্ধ নির্নিমেষ চক্ষুতে চাহিয়া হরিলক্ষ্মীর মনে হইতে লাগিল, ধরিত্রী, দ্বিধা হও !

0 Shares