পাত্রগণ
পাঁচটি মেয়ে স্বপ্নবুড়ি হিংসে
[ পাঁচটি ছোট মেয়ের প্রবেশ ]
প্রথম : | আমি ভাই একটা স্বপ্ন দেখেছি— এমন মজার! |
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম : | কি ভাই— কি স্বপ্ন? বল্ না ভাই— |
প্রথম : | না ভাই, আমি ঐ ওকে বলব না— ও ভারি হিংসুটে: |
পঞ্চম : | আচ্ছা, নাই বা বললি। ভারি তো স্বপ্ন— আমি বুঝি আর স্বপ্ন দেখতে জানিনে— |
প্রথম : | দেখলি ভাই, কি রকম হিংসে! |
দ্বিতীয়, তৃতীয় : | আচ্ছা, ওকে নাই বা বললি, আমাদের বল না: |
চতুর্থ | আর না হয় ও শুনলই বা— তাতে দোষ কি ভাই? |
পঞ্চম : | আমার বয়ে গেছে— ও ছাই স্বপ্ন আমি একটুও শুনতে চাই না: |
প্রথম : | শুনলি ভাই! কি রকম হিংসে করে করে কথা কয়? আমি কি ওকে শুনতে বলেছি? |
চতুর্থ : | কিসের স্বপ্ন ভাই?— রাজহাঁসের? |
প্রথম : | দূৎ! রাজহাঁসের স্বপ্নকে বুঝি মজার স্বপ্ন বলে? |
চতুর্থ : | হ্যাঁ— রাজহাঁসের স্বপ্ন খুব মজার হয়। আমি যখন রাজহাঁসদের সঙ্গে মেঘের মধ্যে ভাসছিলাম, তখন নীল নীল ঢেউগুলো সব আমার গায়ে লাগছিল। আর তারাগুলো সব ফুটেছিল, ঠিক যেন পদ্মফুলের মত! আমার খুব মজা লাগছিল: |
পঞ্চম : | তুই সেখানে দোলনা-দেওয়া লালফুলের বাগান দেখছিলি?— আর পেখমধরা ময়ূর দেখেছিলি? |
চতুর্থ : | কই, না ত! |
পঞ্চম : | আমি দেখেছিলাম। ময়ূরদের পায়ে ঘুঙুর এমনি সুন্দর বাজছিল!— এমন সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, শুনলাম সকালবেলায় বোর্ডিঙের ঘণ্টা বাজছে: |
প্রথম : | দেখলি ভাই, আমি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলুম, এর মধ্যে কি রকম বক্বক্ করতে লেগেছে! ওরা ইচ্ছে করে আমায় বলতে দেবে না: |
দ্বিতীয়, তৃতীয় : | আহা, তোরা একটু থাম না বাপু— |
প্রথম : | আবার কিন্তু ও রকম করলে আমি কক্ষনো বলব না: |
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ : | না, না, কেউ বাধা দেব না— বল্: |
প্রথম : | আমি স্বপ্ন দেখেছি— ঐ বাগানের মধ্যে একটা মেলা হচ্ছে। আমি সেই মেলায় গিয়েছি, আর সেখানে এক মেম সকলকে পুতুল দিচ্ছে— ঠিক এত্তো বড় বড় পুতুল!— তার জন্যে পয়সা নিচ্ছে না!— আমায় ঠিক একটা পুতুল দিল, তার মাথা ভরা কোঁকড়া চুল, এমনি মোটা মোটা গাল, আর ঠিক সত্যিকারের মানুষের মতন কথা বলে: |
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ : | ও—মা—! কি চমৎকার! |
তৃতীয় : | হাত—পা নাড়তে পারে? |
চতুর্থ : | নিজে নিজে চলতে পারে? |
দ্বিতীয় : | হাসতে পারে? |
প্রথম : | হ্যাঁ, হাসতে পারে, খেলতে পারে, সব পারে: |
পঞ্চম : | সত্যিকারের মানুষের মতন তৈরি? |
দ্বিতীয় : | কেন— এখন যে বড় কথা বলতে এয়েছিস? |
তৃতীয় : | তবে যে বলছিলি ছাই স্বপ্ন— তুই একটুও শুনতে চাস না— |
চতুর্থ | তা কেন? তোরাই ত ভাই ওকে শুনতে দিচ্ছিলি না: |
প্রথম : | বেশ করেছি। ও কেন কথায় কথায় হিংসে করে? তারপর শোন— সবাইকে পুতুল দিল, কিন্তু কারু পুতুল ও রকম কথাও কয় না, খেলাও করে না— আর ঐ ও একটা পুতুল পেয়েছিল— নোংরা, কালো, দাঁতভাঙা, বিচ্ছিরি মতন: |
পঞ্চম : | ইস! তা বৈকি! নিজের বেলায় সব ভালো ভালো, আর পরের বেলায় সব নোংরা আর ময়লা আর বিচ্ছিরি! |
প্রথম : | দেখলি ভাই, কি রকম হিংসে করে করে বলছে! মেমসাহেব ও রকম দিয়েছে, তা আমি কি করব ভাই? |
তৃতীয় : | হ্যাঁ, তা ছাড়া এ ত সত্যি নয়— স্বপ্ন: |
দ্বিতীয় : | স্বপ্ন নিয়ে আবার হিংসে কি?— ছি-ছি-ছি! |
চতুর্থ : | হ্যাঁ— তারপর কি হল ভাই? |
প্রথম : | তারপর সে পুতুল নিয়ে কত মজা হল— সব আমার মনেই নেই। শেষটায় কিন্তু ভাই আমার কষ্ট হয়েছিল: |
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ : | কেন? কি হয়েছিল? |
প্রথম : | সে ভাই বলব কি— পুতুলটাকে সবাই নিয়ে দেখছে দেখছে, হঠাৎ দেখি পুতুলটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। আমার ভাই এমন কান্না পেতে লাগল: |
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ : | কি করে ভাঙল ভাই? |
প্রথম : | কি জানি, কি করে! আমার বোধহয়, নিশ্চয়ই ঐ হিংসুটিটা কখন হিংসে করে ভেঙে দিয়েছিল! |
পঞ্চম : | মাগো! এমন বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারে আমার নামে! |
প্রথম : | তা বৈকি! যারা হিংসুটি, তারা স্বপ্নেও হিংসুটি হয়: |
দ্বিতীয় : | হয় না তো কি? নিশ্চয়ই হয়— হিংসুটি! হিংসুটি! |
তৃতীয় : | আমি কিন্তু ভাই যেদিন স্বপ্নে পথ হারিয়েছিলুম, সেদিন ও আমায় পথ বলে দিয়েছিল: |
চতুর্থ : | কি করে পথ হারিয়েছিলি ভাই? |
তৃতীয় : | সেই একটা বাগানের মধ্যে এক বুড়ি একটা কাঠি ছুঁয়ে ছুঁয়ে সবাইকে পাথর করে দিচ্ছিল— আর আমি কিছুতেই পালাবার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারপর ও এসে আমায় একটা লুকোনো পথ দেখিয়ে দিল, সেইখেন দিয়ে আমরা পালিয়ে গেলাম: |
চতুর্থ : | তবু কিন্তু, ভাই, ওরা ওকে হিংসুটি বলে!— আচ্ছা ভাই, তুই বুঝি খালি ময়ূরের স্বপ্ন দেখিস? |
পঞ্চম : | না— সে খালি একদিন দেখেছিলাম। অন্য সময়ে আমি আল্তামাসির স্বপ্ন দেখি: |
তৃতীয়, চতুর্থ : | আল্তা মাসি কে ভাই? |
পঞ্চম : | সে আমার একজন মাসি হয়। তার কেউ নেই কিনা, সব মরে গিয়েছে, তাই সে রোজ রোজ কাঁদে। আমি ভাই স্বপ্ন দেখি, আল্তা মাসির খোকাকে কত করে খুঁজছি; কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আর আল্তামাসির চোখ দিয়ে কেবলি জল পড়ছে: |
প্রথম : | দেখলি ভাই, আমার দেখাদেখি ও আবার এক স্বপ্ন বলতে লেগেছে। এমন হিংসুটে! |
দ্বিতীয় : | ওঃ! আমার ভাই বড় ঘুম পাচ্ছে: |
তৃতীয়, চতুর্থ : | সত্যি, আমারও! |
প্রথম : | আমারও ভাই ঘুম পেয়ে গেল! |
পঞ্চম : | হ্যাঁ, তাই ত। চোখ বুজে আসছে যে! |
[ একে একে সকলে বসিয়া পড়িল, ঘুমে চোখ ঢুলিতে লাগিল। স্বপ্নবুড়ি স্বপ্নের গান গাহিতে গাহিতে সকলের চোখে ঘুমের কাঠি বুলাইয়া দিল। রঙ-মাখানো বিশ্রী চেহারা, ঝুঁটিবাঁধা কে একজন আসিয়া প্রথম ও দ্বিতীয়ার পিছনে দাঁড়াইল। তাহার নাম হিংসে ] | |
পঞ্চম : | ঠিক যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। না, ভাই? |
চতুর্থ : | হ্যাঁ— সত্যি হচ্ছে, কি স্বপ্ন হচ্ছে, কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না: |
তৃতীয় : | ও মা! ও কে ভাই? ঐ যে দাঁড়িয়ে আছে? |
চতুর্থ, পঞ্চম : | মাগো! কি বিশ্রী চেহারা! |
হিংসে : | দেখ্ ত, আমায় চিনিস কিনা? |
প্রথম : | হ্যাঁ,— কোথায় যেন দেখেছি মনে নেই, কিন্তু চেনা চেনা লাগছে: |
দ্বিতীয় : | তুই কোথায় থাকিস ভাই? |
হিংসে : | তাও জানিসনে? এই ত, তোদের মনের মধ্যেই থাকি: |
প্রথম : | মনের মধ্যে থাকে সে আবার কি রকম ভাই? সেখানে কি থাকবার জায়গা আছে? |
হিংসে : | হ্যাঁ, আছে বৈকি। ঘর বাগান জল মাটি আকাশা— সব আছে: |
দ্বিতীয় : | তাই নাকি? তোর নাম কি ভাই? |
হিংসে : | আমার নাম হিংসে— হিংসুটিদের মনের মধ্যে যে থাকে, সেই হিংসে— |
তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম : | হিংসে হাসি চিম্সে বাঁকা— কাল্কুট্কুট্ গরল মাখা: |
দ্বিতীয় : | কি সুন্দর কালো কালো হাত দেখেছিস? |
প্রথম : | হ্যাঁ, আবার মুখে কি সুন্দর রংবেরঙের কাজ করেছে! |
চতুর্থ : | মাগো! ওকে আবার সুন্দর বলছে! |
তৃতীয়, পঞ্চম : | এমন কুচ্ছিত! ছ্যাঃ! |
প্রথম : | আচ্ছা ভাই, যারা হিংসুটি, তারা বুঝি খুব দুষ্টু? |
হিংসে : | হ্যাঁ, দুষ্টু বৈকি— দুষ্টু আর ঝগরাটে— |
প্রথম : | কথায় কথায় বুঝি রাগ করে? |
হিংসে : | হ্যাঁ, নিজেরা রাগ করে আর অন্যদের বলে হিংসুটি: |
দ্বিতীয় : | অন্যদের ভালো দেখতে পারে না, না? |
হিংসে : | এক্কেবারেই পারে না। এমনিও পারে না— স্বপ্নেও পারে না: |
প্রথম : | ঠিক ঐ ওর মতো! |
দ্বিতীয় : | আচ্ছা ভাই, তুই হিংসুটিদের মনের মধ্যে থাকিস কেন? |
হিংসে : | বা! তা নাহলে থাকব কোথায়? তোদের মনের মধ্যে, যেখানে কালো কালো ঝুল-মাখানো পর্দা ঝোলে, সেখানে ছ্যাক্ছেকে আগুন জ্বেলে বসি— আর কাটা কাটা ঝাল ঝাল কথা বানিয়ে খাই। ভারি আরাম! |
তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম : | কি ভয়ানক দুষ্টু! |
হিংসে : | দেখলি! ওরা আমাকে দুষ্টু বলছে, বিশ্রী বলছে— তাই ওদের কাছে আমি একটুও ঘেঁষি না। আর তোরা আমায় লক্ষ্মী বলিস, মনের মধ্যে আদর করে পুষে রাখিস— তাই তোদের সঙ্গে আমার কত ভাব। আয় ভাই আমরা তিনজনে একটা গান গাই: |
[ হিংসে প্রথম ও দ্বিতীয় মেয়ের গান ] | |
আমরা ভাল লক্ষ্মী সবাই তোমরা ভারি বিশ্রী, তোমরা খাবে নিমের পাঁচন, আমরা খাব মিস্রী। আমরা পাব খেলনা পুতুল আমরা পাব চম্চম্, তোমরা ত তা পাচ্ছ না কেউ পেলেও পাবে কম কম । আমরা শোব খাট পালঙে মায়ের কাছে ঘেঁষটে, তোমরা শোবে অন্ধকারে একলা ভয়ে ভেস্তে । আমরা যাব জাম্তাড়াতে চড়ব কেমন ট্রেইনে, চেঁচাও যদি “সঙ্গে নেযাও” বল্ব “কলা এইনে” ! আমরা ফিরি বুক ফুলিয়ে রঙিন জুতোয় মচমচ, তোমরা হাঁদা নোংরা ছিছি হ্যাংলা নাচে ফঁচ্ফঁচ্ । আমরা পরি রেশমি জরি, আমরা পরি গয়না, তোমরা সেসব পাওনা বলে তাও তোমাদের সয় না । আমরা হব লাট মেজাজী, তোমরা হব কিপটে, চাইবে যদি কিচ্ছু তখন ধরব গলা চিপটে ।: |
|
প্রথম : | দেখলি ভাই, কেমন মিষ্টি করে করে কথা বলছে! |
দ্বিতীয় : | দেখলি! আমাদের কত ভালোবাসে, আর ওদের একটুও ভালোবাসে না: |
হিংসে : | তাহলে এখন আসি ভাই? মনে থাকবে ত? এই আমার ছাপ রেখে গেলাম: |
[ কালো কালো আঙুল দিয়া দুইজনের গালে কালো ছাপ লাগাইয়া দিল। জাল গুটাইয়া লইয়া স্বপ্নবুড়ি চলিয়া গেল। আস্তে আস্তে সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল ] | |
তৃতীয় : | ওমা! কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, মনেও নেই: |
চতুর্থ : | কি যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি! সেই হিংসে বলে একজন কে আছে— |
পঞ্চম : | কি আশ্চর্য! আমিও ঠিক তাই দেখেছি! ওদের সঙ্গে তার কত ভাব! |
তৃতীয় : | হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওদের মনের মধ্যে থাকে— |
চতুর্থ : | আর ঝাল ঝাল কথা খায়— |
প্রথম : | ও কি ভাই! তোর গালে অমন দাগ দিয়ে গেল কে? |
তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম : | ও কি! সত্যি সত্যি ছাপ দিয়ে গেছে যে! |
[ দ্বিতীয়ার দাগ মুছিবার চেষ্টা ] | |
সকলে | কি দুষ্টু! কি দুষ্টু! কি দুষ্টু! |
প্রথম : | আবার বলে আমাদের সঙ্গে ভাব করবে! |
দ্বিতীয় : | কক্ষনো আর কোনোদিন ভাব করব না: |
প্রথম : | এমনিও করব না, স্বপ্নেও করব না: |
সকলে : | কক্ষনো না, কক্ষনো না, কক্ষনো না: |