তারাবাঈ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

গভীর রাত্রি। জন-প্রাণীর সাড়াশব্দ নাই। আকাশে কৃষ্ণা পঞ্চমীর চন্দ্র কিরণধারায় সমস্ত পৃথিবীকে পুলকিত করিয়া রাখিয়াছে। নানা জাতীয় নৈশ-কুসুমের গন্ধ বাহিয়া মৃদুমন্দ গতিতে বায়ু বাহিয়া যাইতেছে। এমন সময় রায়গড়ের একটি বৃহৎ উদ্যানমধ্যস্থ ক্ষুদ্র অট্রালিকায় শিবাজী, তাঁহার পিতা শাহজী, শুরু রামদাস স্বামী, বলবন্ত রাও, মালজী প্রভৃতি মারাঠাপ্রধানগণ গুপ্ত পরামর্শের জন্য নিভৃতে সমবেত হইয়াছেন। সকলেই গভীর চিন্তামুক্ত-সকলেই নীরব। এই নৈশ গুপ্ত সভাধিবেশনের কথা আর কেহই অবগত নহে। রাজপুরীর আর কোনও নরনারী এসভার কোনও সংবাদ রাখে না এবং রাখিবারও কোনও প্রয়োজন নাই।

সকলেই নীরবে গৃহতলে সমাসীন। সকলেই গম্ভীর চিন্তায় নির্বিষ্ট। মৌনতা ভঙ্গ করিয়া সহসা শাহজী বলিলেন, “বৎস শিবা! অকারণে রাজ-বিদ্রোহিতা মহাপাপ। আমরা বিজাপুরের সোলতানের অধীনে বেশ আরাম ও স্বচ্ছন্দে দিন গুজরান করছি। রাজ্যের সর্বত্র শান্তি বিশেষ রূপে প্রতিষ্ঠিত। চোর-দস্যুর উৎপাত একেবারেই নাই। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প-কৃষি অসাধারণ উন্নতি লাভ করেছে। জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকলেই তুল্যভাবে শাসিত এবং পালিত হচ্ছে। মুসলমান শাসনে ব্রাহ্মণ শূদ্রের বিচারে কোনও পার্থক্য নাই। উচ্চ রাজকার্যে হিন্দু-মুসলমান সকলেরই সমান অধিকার। তারপর বিজাপুরের সোলতান, শুধু আমাদের রাজাই নহেন; আমাদের প্রভু এবং অন্নদাতা। আমি, যে রাজার একজন অমাত্যের মধ্যে গণ্য, সেই রাজার বিরুদ্ধাচরণ করা পাপ-মহাপাপ! ধর্ম এ পাপ কখনও সইবে না। এতে কেবল ধ্বংস ও অকীর্তিই আনয়ন করবে।

“প্রবলপ্রতাপ সোলতানের বিরুদ্ধাচরণ করা ছেলেমী এবং পাগলামী মাত্র। হঠাৎ আক্রমণ করে তাঁর দু’চারটি দুর্গ এবং দশ-বিশ খানা গ্রাম দখল করেছ বলে, সম্মূখ সমরে তার পরাক্রান্ত বাহিনীকে কোনও রূপে পরাজিত করতে পারবে, ও রূপ কল্পনা তুমি স্বপ্নেও পোশন করো না।

“সোলতান অত্যন্ত সরলচেতা এবং উদার প্রকৃতির লোক। তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং রক্তপাতের পক্ষপাতী নহেন। তাই আমাকে বিনা যুদ্ধে গোলযোগ মিটাবার জন্য পাঠিয়েছেন। বৎস, যদি তোমার পিতার জীবনকে বিপন্ন না করতে-অধিকন্ত নিজেকেও রক্ষা করতে চাও, তা’ হ’লে সোলতানের বশ্যতা স্বীকার করে, রাজভক্ত প্রজারূপে বাস করাই সর্বদা যুক্তিসঙ্গত। তুমি যেসমস্ত দুর্গ অধিকার করেছ, তুমিই তার অধ্যক্ষ নিযুক্ত থাকবে। এ অপেক্ষা মহামাননীয় সোলতানের নিকট আর কি অনুগ্রহ পেতে চাও? ইহা বাস্তবিক লোকাতীত মহানুভবতা। দেবতারাও ইহার অধিক অনুগ্রহ করতে পারে না।

“প্রিয় শিবা! সোলতান আমার বিলম্ব দেখলে নিশ্চয়ই সন্দিগ্ধ হবেন। তুমি সেনাপতি আফজাল খাঁর নিকটে আগামীকল্য বশ্যতা স্বীকার করলেই, সমস্ত অশান্তি ও গোলযোগ মিটে যায়। এ শুভকার্যে আর বিলম্ব করা উচিত নহে। চিন্তা, করে দেখ-সামান্য অবস্থায় সামান্য বংশে জন্মগ্রহণ করে এবং সামান্য লোক হয়ে বিজাপুরের সম্মনিত সামন্তের মধ্যে গণ্য হওয়া ভাল, কি জনসমাজ কুক্কর তুল্য ঘৃণিত দস্যু অভিহিত হয়ে সর্বদা বন-জঙ্গলে উৎকণ্ঠিতভাবে জীবনযাপন করা ভাল।”

পিতার কথায় শিবাজী ক্ষণকাল নীরব রহিলেন। তারপরে বলিলেন, “বাবা! আপনি যা” বললেন, তা’ উচ্চাকাঙ্খাবিহীন হীনচেতা ব্যক্তিদিগের নিকট নিতান্তই যুক্তিসঙ্গত বটে, যশোলোলুপ রাজ-পদাকাঙ্খী ব্যক্তিদিগের পক্ষে এ উপদেশ গ্রাহ্য হতে পারে না। রাজ্য কাহারও পৈতৃক বা বিধি-নির্দিষ্ট নিজস্ব বস্তু নহে। যে বাহুবলে অধিকার করতে পারে, তারই হয়ে যায়। সুতরাং রাজবিদ্রোহিতা কথাটার কোন মূল্য নাই। বিশেষত, ইহা যে কোনও পাপ কার্যের মধ্যে গণ্য, তা’ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না।

“পৃথিবীর রাজপদ যখন সর্বশ্রেষ্ঠ পদ, তখন ছলে-বলে কলে-কৌশলে যে কোনও প্রকারে হউক, তা’ লাভ করাই আমার মতে পরম ধর্ম। যখন আমি সেই ধর্মে দীক্ষিত হয়েছি, তখন আর সোলতানের নিকট বশ্যতা স্বীকার করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

শাহজীঃ বৎস শিবা! তুমি যা’ বললে, তা’ অনেকটা সত্য বটে। কিন্তু তুমি কি বাহুবলে রাজ্য অধিকার করেছ? কিম্বা করতে সমর্থ? তুমি অত্যন্ত ভুল বুঝছ! তুমি যে বৃত্তি অবলম্বন করেছ, তা’ বীরপুরুষ বা রাজকর্মী ব্যক্তির বৃত্তি বলে কদাপি অভিহিত হতে পারে না, পূর্বেই বলেছি, ইহা অতি জঘন্য দস্যুবৃত্তি! দস্যু সকলেরই ঘৃণার পাত্র এবং শূল-দন্ডে বধ্য।

শিবাঃ কিন্তু এই দস্যুবৃত্তি ব্যতীত যখন অন্য কোনও উপায় অভীষ্ট সিদ্ধির সম্ভাবনা নাই, তখন এই দস্যুভাবেই আমাকে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সাধনা করতে হবে। আমি এই কর্তব্য হতে কিছুতেই আর এখন বিচলিত হতে পারি না। আপনি আর বিজাপুরে ফিরে যাবেন না। পর্বত ও অরণ্যসঙ্কুল দুর্গম কঙ্কন প্রদেশের দুর্গে যেয়ে সুখে বাস করুন। আপনার কেহ কেশও স্পর্শ করতে পারবে না। আমি এদিকে ছলে-বলে কলে-কৌশলে যে রূপেই হউক, সোলতানের আধিপত্য নষ্ট করে রাজ্যস্থানের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করব। যদি কোনও বিপদ ঘটে, তা’ আমার প্রতিই ঘটবে। যদি কিছু অধর্ম হয়, তা আমারই হবে। সে জন্য আপনার কোনও চিন্তা নাই। আপনি আমার আর কোনও কার্যেরই আলোচনা করবেন না।

শিবাজীর কথা শুনিয়া একটু রুষ্ট হইয়া রুক্ষ স্বরে বলিলেন, “কি আশ্চর্য, তোমার পাপ কার্য-মহাপাপ কার্যেরও সমালোচনা করতে পারব না। আমি এমন রাজদ্রোহী দস্যু পুত্রের মুখ দেখতেও ইচ্ছা করি না! তোমার যা’ ইচ্ছা, তাই করতে পার, কিন্তু পরিণামে এই ঔদ্ধতা এবং পাপের জন্য তোমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।” এই বলিয়া শাহজী নিতান্ত ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত অবস্থায় সেই নির্ভৃত গৃহ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।

শাহজী নির্ভৃত গৃহ হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেলে, শিবাজী এবং রামদাস স্বামী প্রভৃতি মিলিয়া যে পরামর্শ করিলেন, তাহা যার-পর-নাই ঘৃণিত এবং পাপজনক! আফজাল খাঁকে সহসা আক্রমণ করিয়া বধ করাই তাঁহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য! তাঁহাকে বধ করিতে পারিলে, বিজাপুরাধিপের দক্ষিণ হস্ত ভগ্ন হইবে বলিয়া শিবাজীর দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ আফজাল খাঁর ন্যায় এরূপ তেজীয়ান এবং মহাবীর সেনাপতি লাভ বহু ভাগ্যের কথা। শিবাজী অনেকবার বলিলেন যে, ‘আফজাল খাঁর ন্যায় বীর পুরুষের সাহায্য পাইলে তিনি দশ বৎসরের মধ্যে সমস্ত দাক্ষিণাত্যে জয়পাতাকা’ উড্ডীন করিতে পারেন।’ এহেন আফজাল খাঁকে কোনও রূপ নিহত করিতে পারিলে, তাঁহার উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথ যে অনেকটা নিস্পণ্টক হয়, তদ্বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নাই। সুতরাং আফজাল খাঁকে গুপ্তভাবে হত্যা করিবার জন্য আয়োজন চলিতে লাগিল।

0 Shares