ফিরোজা বেগম

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দিল্লীর হেরেমের নিভৃত করে বাদশাহ্‌ শাহ্‌ আলম, শেখুল-ইসলাম মওলানা আমিনার রহমান, উজীর সফদরজঙ্গ, মালবের শাসনকর্তা আফ্‌তাব আহ্‌মদ খান এবং মোসাহেব মালেক আনোয়ার উপস্থিত। বাদশাহ্‌ একখানি সোফায় উপবিষ্ট, আর সকলেই দ্বিরদ-রদ-নির্মিত পুরু গদিবিশিষ্ট কুর্সীতে সমাসীন।

এইটি অন্তঃপুরের সম্মিলন কক্ষ। একটি ১০১ ডালের স্বর্ণখচিত ঝাড়ে কর্পূরমিশ্রিত মোমবাতি জ্বলিয়া জ্বলিয়া শুভ্র ও সুগন্ধি আলোক বিকীর্ণ করিতেছে। দেওয়ালে দুগ্ধফেননিভ শ্বেত মর্মরের উপরের সুবর্ণের নানাবিধ চিত্র ও নক্‌শা অঙ্কিত। সে কারুকার্য একদিকে যেমন সূক্ষ্ম কৌশলের অভিব্যক্তি, অন্যদিকে তেমনই গঠনপারিপাট্যের চরম গৌরবের পরিচায়ক! মধ্যখানে একটি হস্তিদন্ত এবং আবলুস কাষ্ঠনিনির্মত মেজ। সে মেজের উপরে সমস্ত পৃথিবীর বিস্তৃত চিত্র সুবর্ণে অঙ্কিত। মেজের একপার্শ্বের কতকগুলি সচিত্র গ্রন্থ। দক্ষিণর দেওয়ালে জগদ্বিজয়ী বীরকুলের গৌরবকেতন মহাতেজী তাইমুরের আশ্বারোহী কৃপাণ-পাণি মূর্তি! তাইমুরের চক্ষু হইতে প্রভাত-তারকার ন্যায় বিশ্ববিজয়িনী প্রভা নির্গত হইতেছে। মুখমণ্ডলে প্রখর বীর্যভাতির সঙ্গে নিবিড় গাম্বীর্য! হঠাৎ দেখিলে চিত্রখানিকা সজীব বলিয়া বোধ হয়।

তাইমুরের সম্মুখে চীন, মঙ্গোলিয়া, মাঞ্চুরিয়া, রুশিয়া, পারস্য, ভারতবর্ষ, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, জর্জিয়া, ক্রিমিয়া, আষ্টোকান, নরওয়ে সুইডেন, ডেনমার্ক তিব্বত, নেপাল, ভোটান এবং খোরসান প্রভৃতি দেশের সোলাতান, সম্রাট, আমীর, মহারাজা এবং রাজগণ উপঢৌকন হস্তে দণ্ডায়মান। তাইমুরের অশ্বের পদতলস্থ নাল হইতে প্রস্তরাঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতেছে। ছবিখানি দেখিলেই কাপুরুষের ভীতি এবং বীরপুরুষের মনে আনন্দ ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। আওরঙ্গজেব এই ছবির চিত্রকর চীনকিচ খানকে সস্তুষ্ট হইয়া লক্ষ টাকা দান করিয়াছিলেন। এই চিত্রের পার্শ্বেই তাইমুরের জ্ঞানপিপাসু বিদ্যানুরাগিণী প্রাতঃস্মরনীয়া বেগম-বিবি খানমের প্রশান্ত মুর্তি! মরি মরি! কি শোভনীয় এবং শ্রদ্ধা-আকর্ষিণী মূর্তি! বেগম বালারুণ-কিরণ-রাগ-রঞ্জিত গগনতলে একটি পর্বর্তের ক্ষুদ্র শৃঙ্গের শ্যামল সানুদেশে সমাসীনা।

সম্মূখের একটি ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী কুলুকুলু নাদে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ তুলিয়া বহিয়া যাইতেছে। জলের উপরে অরুণের স্বর্ণকান্তি পড়ায় গলিত সুবর্ণধারা বলিয়া বোধ হইতেছে। বেগমের হস্তে কোরান শরিফ। তিনি বিরাট ও বিশাল জ্ঞানমন্দির সমরকন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে পরম প্রীতিপূর্ণ নেত্রে চাহিয়া রহিয়াছেন। বেগমের দক্ষিণ পার্শ্বে সুসজ্জিত স্তূপাকার গ্রন্থশ্রেণী। বামপার্শ্বে পুষ্পোদ্যান। তাহাতে নানাজাতীয় ফুল ফুটিয়াছে। কয়েকটি গোলাপের উপর বুলবুল বসিয়া মধুর রাগালাপ করিতেছে। একস্থানে তিনটি হরিণ-শিশু এবং পাঁচটি ময়ূর পরস্পরের দিকে প্রীতিপূর্ণ আঁখিতে চাহিয়া রহিয়াছে! মধ্যে কমল সরোবরে কয়েক বর্ণের কমল ফুটিয়াছে, সেই ফুল্ল কমলদলে বিচিত্র চন্দ্রক-ভূষিত নায়নানন্দকর প্রজাপতিগুলি কেহ বসিয়া বসিয়া, কেহ উড়িয়া মধুপান করিতেছেন।

একধারে বহুসংখ্যক সুন্দরকান্তি ছাত্র ও ছাত্রী অধ্যয়নে লিপ্ত রহিয়াছে। মহারাজ্ঞীর চক্ষুর দৃষ্টিতে প্রতিভা এবং শান্তির পরম বিকাশ হইয়াছে। বিবি খানমের মূর্তিটি বিশ্বপ্রহাদিনী ঊষার ন্যায় মনোহারিণী, অথচ পবিত্র এবং গম্ভীর। মূর্তিটি এমনি সুকৌশলে অঙ্কিত যে দর্শন মাত্রই রাজ্ঞীর জ্ঞান-পিপাসা, সৌন্দর্যপ্রীতি এবং বিদ্যাচর্চা মহান ভাবে দর্শকের হৃদয় বিহ্বল হইয়া পড়ে। এই চিত্রে জ্ঞানপিপাসা এবং প্রতিভার যে প্রভাম ও প্রশান্ত মহিমা দেখা যাইতেছে, তাহার সামান্য অংশও হিন্দুরা সরস্বতী মূর্তিতে এবং গ্রীকরা “মিউজে” ফুটাইতে পারে নাই।

এই মহারাজ্ঞীর কোটী কোটী মুদ্রা ব্যয় করিয়া সমরকন্দের পৃথিবী-বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রাবাস নির্মাণ করিয়ছিলেনে। নারী কর্তৃক পৃথিবীতে এরূপ বিরাট বিদ্যামন্দির আর কখনও স্থাপতি হয় নাই।

চিত্র দুইটা পাশাপাশি থাকায় বীরত্ব ও জ্ঞানের প্রভাব ও পার্থক্য সুস্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইতেছে। আবার উভয়ের সম্মিলন কেমন প্রীতিপূর্ণ আনন্দজনক এবং অপার্থিব শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রকাশকর, তাহাও অনায়াসে বুঝিতে পারা যায়। এ চিত্র প্রসিদ্ধ চিত্রকর আরসালমান খানের রচিত। আওরঙ্গজেব এ চিত্রের জন্যও লক্ষ্য টাকা দান করিয়াছিলেন। ফলতঃ, এই দুইখানি চিত্র এমনি সুন্দর স্বাভাবিক এবং শিক্ষাপ্রদ যে, দেখা মাত্রই সকলে মুগ্ধ হয়। ইউরোপের মাইকেল আঞ্জোলা বা র‌্যাফেলের পক্ষে ভাবপূর্ণ মহান চিত্র অঙ্কিত করা সম্ভবপর ছিল না। এই চিত্র ব্যতীত দিল্লীর অন্যান্য বহু সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর এবং বীরপুরুষের চিত্র শোভা পাইতেছে।

বাদশাহ্‌ শাহ্‌ আরম আলবোলা টানিতে টানিতে গৃহমধ্যে সুগন্ধি তাম্রকুটের ধূসর ধূমের কুণ্ডলী ত্যাগ করিয়া তাইমুরের চিত্রের দিকে তাকাইয়া একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন। তারপর একটু থামিয়া বলিলেন, “হায়! কি ভয়াবহ অধঃপতন! কি বীরত্বব্যঞ্জক প্রতিভামণ্ডিত মূর্তি! কিবা সাহস! পদভরে পৃথিবী কম্পিত! তরবারি-মুখে রক্তধারা পরিদৃশ্যমান! অশ্ব-পদাঘাতে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ বিকীর্ণ হইতেছে! পৃথিবীর রাজন্যবৃন্দ ভয়ে কম্পিত এবং করজোড়ে নজরহস্তে দণ্ডায়মান। আর আমরা?-এই ভুবনবিখ্যাত বীরবংশের সন্তান আমরা। আমাদের তেজঃ-বীর্য, সাহস-শৌর্য কালের গর্ভে বিলীন! বিলাসব্যসনে দেহ ক্ষীণ ও দুর্বল। মনের ভিতরে কেবলই আশঙ্কা ও ভীতি! মনুষ্যত্বহীন-চরিত্রহীন-অধ্যবসায়হীন-ধন মান রাজত্ব প্রত্যহ লুপ্ত হইতেছে। কিঙ্করেরাও মাথা তুলিতেছে। হা অদৃষ্ট! হয় বিধি! তোমার মনে কি ইহাই ছিল! আহো! সিংহের বংশে শৃগাল, বনস্পতির বংশ তৃণ এবং সম্রাটের বংশে ভিখারী হইলাম। এমনি দুর্দশা যে, নিজের শরীরটা পর্যন্ত রক্ষা করিতে অক্ষম। যুদ্ধের দুন্দু নিনাদে পূর্বপুরুষেরা একিদিন নাচিয়া উঠিতেন। আর আমরা বাঈজীদিগের নূপুরের রুনুঝুনু ধ্বনিতে নাচিয়া উঠি। আমরা অগ্নিতে জন্মিয়া ছাই! দাহিকা-শক্তিহীন।

“অদৃষ্টের কি বিচিত্র গতি! যে মারাঠীরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত চরণতলে পতিত ছিল, আজ তাহারাই আমাদের দণ্ডমুণ্ডের প্রভু হইয়া পড়িতেছে! হায়! যে দিল্লীর নামে জগৎ কম্পিত ছিল, আজ সেই দিল্লী দস্যুপদতলে দলিত, মথিত এবং লুণ্ঠিত! হা খোদা! এ লাঞ্ছনা, এ যন্ত্রণা তা আর সহ্য হয় না” এই বলিয়া শাহ্‌ অশ্রুপ্লুত নেত্রে আরও একটি দীর্ঘঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন।

আফতাবঃ মুসলমানের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ভারতবর্ষ হতে একেবারেই লুপ্ত হবে। এখনও যা’আছে তা’ও থাকবে না। হা খোদা! অবশেষে কি না বর্গীরা দিল্লীর ধনভাণ্ডারও লুণ্ঠন করল, বর্গীর পদ চিহ্নে দিল্লী অপবিত্র হ’ল। বাদশাহের সম্মানটুকুও রইল না! তাইমুর-খান্দানের এ অবমানানা একেবারেই অসহ্য!

সফদরজঙ্গঃ আপনি বলছেন, অসহ্য? কিন্তু ভারতীয় অন্যান্য রাজা নবাবদের ত এতটুকুও টনক নড়ল না! আজ দিল্লীর অসম্মান হ’ল, কালই অযোধ্যা, হায়দ্রাবাদ, সিন্ধু, বাঙ্গালা এবং কাশ্মীরের হবে। মারাঠীর অত্যাচার হ’তে কেউই রক্ষা পাবে না। কিন্তু এই সমস্ত নিমকহারামের দল যদি অন্ততঃ আপনাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যও দিল্লীর তখ্‌তের সম্মান রক্ষা করতে প্রস্তুত হ’ত, তা’হলে মারাঠীদিগকে দমন করা কঠিন হ’ত না।

মালেকঃ এরা একত্র হবে কি? এরা ত পরস্পর নিজেরাই যুদ্ধ-বিগ্রহে মত্ত। কে কা’কে মেরে বড় হবে সেই চেষ্টায়ই রত! ফলে সকলেই মারা যাবে। জাতীয়তার ভাব একেবারেই বিলুপ্ত হয়েছে। খোদার কি মর্জী বোঝা যায় না।

শেখুল ইসলামঃ খোদার মর্জী বুঝা যাবে না কেন? খোদাতা’লা ত তাঁর মর্জী সুস্পষ্ট করেই তাঁর কালামে বুঝিয়ে দিয়েছেন। চরিত্রহীন জাতির অধঃপতন অনিবার্য। ইহা ত খোদার মর্জী। খোদা ত স্পষ্টই বলেছেন যে, ‘যতদিন পর্যন্ত কোনও জাতি চরিত্রকে বিকৃত না করে, ততদিন তাদের সৌভাগ্য নষ্ট হয় না।’ এরূপ স্পষ্ট ঘোষণার পরেও যদি আমরা চরিত্র রক্ষা করতে না পারি, তা’ হরে তার জন্য কে দায়ী হবে?

“চরিত্রবান হবার জন্যই ধর্মের আবশ্যক। কিন্তু আমরা তা’ ভুলে গিয়েছি। সত্যবাদিতা, জিতেন্দ্রিয়তা, স্বার্থত্যাগ, ঐক্য, সখ্য, সহানুভূতি ও পরস্পরের প্রতি প্রেম, যে জাতির ভূষণ এবং নিত্যধর্ম ছিল; আজ তাদের ভিতরে কেবল অনৈক্য, হিংসা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা এবং স্বার্থপরতাই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। কি ভয়ানক অধঃপতন! বাইরের অধঃপতন আপনারা যা’ দেখছেন, ভিতরের অধঃপতন অর্থাৎ মনের অধঃপতন তার অনেক বেশী হচ্ছে-সর্বাগ্রে হয়েছে।

“মনের অধঃপতনের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রের অধঃপতন, আর চরিত্রের অধঃপতনের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের অধঃপতন হয়। মনের ভিতরের যেমন ভাবের, যেমন কল্পনার প্রদীপ জ্বলে, বাইরে তারই আলো পড়ে। চরিত্রের কেন্দ্র হচ্ছে মন, অথবা মনের বহির্বিকাশ হচ্ছে চরিত্র্‌। আমরা সেই চরিত্রের বিকাশ হারিয়েছী। খোদার ইচ্ছা এবং আদেশের বিরুদ্ধে চলেছি। সুতরাং আমাদের অধঃপতন এবং দুর্গতি অনিবার্য। আমরা ধর্মকে রক্ষা করি নাইঃ সুতরাং ধর্মও আমাদিগকে রক্ষা করবে না।

মালেকঃ কেন, আমরা ধর্ম রক্ষা না করলে ধর্ম কি আমাদিগকে রক্ষা করতে পারে না?

শেখঃ কখনই নয়। নদীতে নৌকা বাইবার সময় যেমন মানুষই নৌকাকে বহন করায় মানুষ নিজেও তৎসহ বাহিত হয়; ধর্মও ঠিক তাই। ধর্মকে রক্ষা করলে আমরাও রক্ষা পাই। নৌকা ডুবিয়ে দিলে আরোহী এবং মাঝী-মাল্লা যেমন ডুবে মরে, ধর্ম ডুবালে আমরাও তেমনি ডুবে মরি।

মালেকঃ কিন্তু ধর্মকে ত আমরা খুবই মানি। কোরআন ও হাদিসকে ত পূর্বের ন্যায়ই সম্মান করি। নামাজ রোজা ও আমরা ছেড়ে দেই নাই।

শেখঃ কোরআন হাদিসকে মানেন, ইহা মিথ্যা কথা। কোরান হাদিসকে মানরে ব্যসন-বিলাস, কামুকতা, মিথ্যাবাদিতা, কাপুরুষতা এবং অনৈক্য কখনও আমাদের ভিতরে প্রবেশ করত না।

“কোরআনকে মানার অর্থ নয় যে, ভক্তির সহিত কোরআন শরীফকে মস্তকে রাখা বা চুম্বন করা। কোরআনকে মানার অর্থ এই যে, কোরআনের উপদেশ অনুসারে নিজের চরিত্রকে রক্ষা করা। নামাজ রোজার কথা যা’ বললেন তা’ অনেকটা ঠিক। এখনো বহু লোক নামাজ পড়ে ও রোজা রাখে বটে। কিন্তু তারা নামাজ রোজার কোনও উদ্দেশ্য বুঝে না।

“তৌহিদের তেজে তেজীয়ান্‌ করাই নামাজের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ নামাজী ব্যক্তি অটুট বিশ্বাসী, সুতারং অতুল বীর্যশালী হবে। তাঁরা অন্যান্য অসত্যের প্রতি বজ্রাদপি কঠোর এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতি কুসুমাদপি কোমল হবেন। চরিত্রে বল ও তেজ লাভ করাই নামাজের উদ্দেশ্য। রসান দিলে স্বর্ণের বর্ণ যেমন উজ্জ্বল হয় নামাজও মুসলমানের চরিত্রকে তেমনি উজ্জ্বল এবং প্রভামণ্ডিত করবে। কিন্তু আজকার দেখা যায়, অনেক মুসল্লী নীচমনা, স্বার্থপর, হিংসুক ও কাপুরষ। তা’রা নামাজের অর্থ বা উদ্দেশ্য কিছুই অবগত নয়। অনেকে শুধু লোক দেখাবার জন্য নামাজ পড়ে।

“রোজা মসুলমানকে সংযম ও সহানুভূতি শিক্ষা দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয, আমাদের চরিত্রে সংযম ও লোকহিতৈষণা বা সহানুভূতির একান্তই অভাব হয়েছে। রোজা ও নামাজ আমাদের একটি ফ্যাসান এবং পদ্ধতি হয়ে পড়েছে। রোজা নামাজের দ্বারা চরিত্রে সংযম ও পরাক্রম লাভ করতে হবে, তা’আমরা ভুলে গিয়েছি। নৌকায় বা যানে উঠে কেউ যদি নিজের গন্তব্য পথ ভুলে যায়, তা’হলে সে যেমন আরও বিপাকে পড়ে, রোজা নামাজের উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ্য না রাখায় আমাদেরও তেমনি সর্বনাশ হচ্ছে। চরিত্রের উন্নতিই হচ্ছে যে একমাত্র ধর্ম, তা’ যেন আমরা ভুলে না যাই। এর উপরেও আরও একটি পরম ও চরম কর্তব্য আছে। তা’ই হচ্ছে ইসলামের বিশেষত্ব।

মালেকঃ তা’ কি?

শেখঃ তা’ হচ্ছে সর্বদা সঙ্ঘবদ্ধ থেকে সকল বিষযে ইসলামের প্রধান্য রক্ষা করা।

সফদরঃ তবে ত আমরা ইসলাম হ’তে বহু দূর সরে পড়েছি!

বাদশাহঃ সরে পড়েছি বলেই ত আজ দূর্দশা। কাঠ পচে গেলেই তা’তে পোকা ধরে। তাজা কাটে পোকা ধরে না। পানি পচে গেলই তা’হতে দুর্গন্ধ নির্গত হয় এবং শৈবাল জন্মে। নির্মল বিশুদ্ধ জলে গন্ধেও হয় না এবং শেবাল জন্মে না। তেমনি চরিত্রবান জাতিতে কখনও অধঃপতনের ঘুণ ধরে না, তাদের মধ্যে দুর্গতির শৈবাল জন্মগ্রহণ করে না।

এমন সময় বাদশাহ্‌ আলমের শ্যালক আফসার-উদ্দৌলা সেখানে আসিয়া উপস্থিত ইহলেন। সালাম এবং সাদর সম্ভাষণের পরে সকলেই সোৎসুক চিত্তে তাঁহার কথা শুনিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।

বাদশাহঃ কতদূর কি হ’ল? কেমন বুঝলেন?

আফসারঃ কি আর বুঝব, সকলই পণ্ডশ্রম। বাঙ্গলার নবাব আলীবদী খাঁ পীড়িত- উদরী রোগে আক্রান্ত। তিন গভীর দুঃখ ও সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। কিন্তু বেচারা দীর্ঘকাল পীড়িত্ত – কি করে মহাসমরের আয়োজন করেন। অযোধ্যার সুজা-উদ্দৌলা মারাঠীদিগের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ। তিনি যুদ্ধবিগ্রহের নামে ভীত এবং সঙ্কুচিত। কিছুইতেই তাঁকে সম্মত করাতে পারলাম না। হায়দ্রাবাদের নিজামও অসম্মত।

বাদশাহঃ তিনিও সম্পুর্ণ উদাসীন। তিনি কেবল নিজ রাজ্য রক্ষার জন্যই ব্যস্ত। রোহিলাদিগের অর্থাভাব সত্ত্বেও তারা জেহাদ যোগ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু এই বিরাট ব্যাপারে শুধু রোহিলাদের সাহায্যে কি হবে?

বাদশাহঃ হায় ইস্‌লাম! তোমার আজ এই অসম্মান! মুসলমানের আজ কি ভীষণ পরিণতি!

শেখঃ আমাদের কল্পনা ও আশা বর্তমান অবস্থায় অসম্ভব।

সফদরঃ দেখছি মরাঠীরাই ভারতের সার্বভৌম প্রভু হবে।

বাদশাহঃ বৃথা পরিশ্রম! বৃথা পরিশ্রম! অদৃষ্টের ভীষণ পরিহাস!!

0 Shares