নববিধান

এক

এই আখ্যায়িকার নায়ক শ্রীযুক্ত শৈলেশ্বর ঘোষাল পত্নীবিয়োগান্তে পুনশ্চ সংসার পাতিবার সূচনাতেই যদি না বন্ধুমহলে একটু বিশেষ রকমের চক্ষুলজ্জায় পড়িয়া যাইতেন ত এই ছোট্ট গল্পের রূপ এবং রঙ বদলাইয়া যে কোথায় কি দাঁড়াইত, তাহা আন্দাজ করাও শক্ত। সুতরাং ভূমিকায় সেই বিবরণটুকু বলা আবশ্যক।

শৈলেশ্বর কলিকাতার একটা নামজাদা কলেজের দর্শনের অধ্যাপক,—বিলাতী ডিগ্রী আছে। বেতন আট শত। বয়স বত্রিশ। মাস-পাঁচেক পূর্বে বছর-নয়েকের একটি ছেলে রাখিয়া স্ত্রী মারা গিয়াছে। পুরুষানুক্রমে কলিকাতার পটলডাঙ্গায় বাস। বাড়ির মধ্যে ওই ছেলেটি ছাড়া, বেহারা-বাবুর্চি, সহিস-কোচম্যান প্রভৃতিতে প্রায় সাত-আটজন চাকর। ধরিতে গেলে সংসারটা একরকম এইসব চাকরদের লইয়াই।

প্রথমে বিবাহ করিবার আর ইচ্ছাই ছিল না। ইহা স্বাভাবিক। এখন ইচ্ছা হইয়াছে। ইহাতেও নূতনত্ব নাই। সম্প্রতি জানা গিয়াছে, ভবানীপুরের ভূপেন বাঁড়ুজ্যের মেজমেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করিয়াছে এবং সে দেখিতে ভাল। এরূপ কৌতূহলও সম্পূর্ণ বিশেষত্বহীন, তথাপি সেদিন সন্ধ্যাকালে শৈলেশ্বরের‌ই বৈঠকখানায় চায়ের বৈঠকে এই আলোচনাই উঠিয়া পড়িল। তাহার বন্ধুসমাজের ঠিক ভিতরের না হইয়াও একজন অল্প বেতনের ইস্কুল-পণ্ডিত ছিল। চা-রসের পিপাসাটা তাহার কোন বড় বেতনের প্রফেসারের চেয়েই ন্যূন ছিল না। পাগলাটে গোছের বলিয়া প্রফেসাররা তাহাকে দিগ্‌গজ বলিয়া ডাকিতেন। সে হিসাব করিয়াও কথা বলিত না, তাহার দায়িত্বও গ্রহণ করিত না। দিগ্‌গ‌জ নিজে ইংরাজী জানিত না, মেয়েমানুষে একজামিন পাশ করিয়াছে শুনিলে রাগে তাহার সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া যাইত। ভূপেনবাবুর কন্যার প্রসঙ্গে সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল, একটা বৌকে তাড়ালেন, একটা বৌকে খেলেন, আবার বিয়ে! সংসার করতেই যদি হয় ত উমেশ ভট্‌চায্যির মেয়ে দোষটা করলে কি শুনি? ঘর করতে হয় ত তাকে নিয়ে ঘর করুন।

ভদ্রলোকেরা কেহই কিছু জানিতেন না, তাঁহারা আশ্চর্য হইয়া গেলেন। দিগ্‌গজ কহিল, সে বেচারার দিকে ভগবান যদি মুখ তুলে চাইলেন ত তাকেই বাড়িতে আনুন—আবার একটা বিয়ে করবেন না। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ! পাশ হয়ে ত সব হবে! রাগে তাহার দুই চক্ষু রাঙ্গা হইয়া উঠিল। শৈলেশ্বর নিজেও কোনমতে ক্রোধ দমন করিয়া কহিলেন, আরে, সে যে পাগল দিগ্‌গজ!

কেহ কাহাকেও পাগল বলিলে দিগ্‌গজের আর হুঁশ থাকিত না, সে ক্ষেপিয়া উঠিয়া কহিল, পাগল সব্বাই? আমাকেও লোকে পাগল বলে—তাই বলে আমি পাগল!

সকলেই উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন। কিন্তু তাই বলিয়া ব্যাপারটা চাপা পড়িল না। হাসি থামিলে শৈলেশ লজ্জিতমুখে ঘটনাটা বিবৃত করিয়া কহিল, আমার জীবনে সে একটা অত্যন্ত Unfortunate ব্যাপার। বিলাতে যাবার আগেই আমার বিয়ে হয়, কিন্তু শ্বশুরের সঙ্গে বাবার কি একটা নিয়ে ভয়ানক বিবাদ হয়ে যায়। তা ছাড়া মাথা খারাপ বলে বাবা তাঁকে বাড়িতে রাখতেও পারেন নি। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে আমি আর দেখিনি। এই বলিয়া শৈলেশ জোর করিয়া একটু হাসির চেষ্টা করিয়া কহিল, ওহে দিগ্‌গজ! বুদ্ধিমান! তা’ না হলে কি তাঁরা একবার পাঠাবার চেষ্টাও করতেন না? চায়ের মজলিসে গরহাজির ত কখনো দেখলুম না, কিন্তু তিনি সত্যি সত্যিই এলে এ আশা আর করো না। গঙ্গাজল আর গোবর ছড়ার সঙ্গে তোমাদের সকলকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে তবে ছাড়বেন, এ নোটিশ তোমাদের আগে থেকেই দিয়ে রাখলুম।

দিগ্‌গজ জোর করিয়া বলিল, কখ্‌খনো না!

কিন্তু এ কথায় আর কেহ যোগ দিলেন না। ইহার পরে সাধারণ গোছের দুই-চারিটি কথাবার্তার পরে রাত্রি হইতেছে বলিয়া সকলে গাত্রোত্থান করিলেন। প্রায় এমনি সময়েই প্রত্যহ সভা ভঙ্গ হয়, হইলও তাই। কিন্তু আজ কেমন একটা বিষণ্ণ ম্লান ছায়া সকলের মুখের ‘পরেই চাপিয়া রহিল—সে যেন আজ আর ঘুচিতে চাহিল না।

দুই

বন্ধুরা যে তাহার তৃতীয়বার দার-পরিগ্রহের প্রস্তাব অনুমোদন করিলেন না, বরঞ্চ নিঃশব্দে তিরস্কৃত করিয়া গেলেন, শৈলেশ তাহা বুঝিল। একদিকে যেমন তাহার বিরক্তির সীমা রহিল না, অপরদিকে তেমনি লজ্জারও অবধি রহিল না। তাহার মুখ দেখানো যেন ভার হইয়া উঠিল। শৈলেশের আঠার বৎসর বয়সে যখন প্রথম বিবাহ হয়, তাহার স্ত্রী ঊষার বয়স তখন মাত্র এগার। মেয়েটি দেখিতে ভাল বলিয়াই কালীপদবাবু, অল্পমূল্যে ছেলে বেচিতে রাজী হইয়াছিলেন, তথাপি ঐ দেনা-পাওনা লইয়াই শৈলেশ বিলাত চলিয়া গেলে দুই বৈবাহিকে তুমুল মনোমালিন্য ঘটে। শ্বশুর বধূকে একপ্রকার জোর করিয়াই বাপের বাড়ি পাঠাইয়া দেন, সুতরাং পুত্র দেশে ফিরিয়া আসিলে নিজে যাচিয়া আর বৌ আনাইতে পারিলেন না। ইচ্ছাও তাঁহার ছিল না। ওদিকে উমেশ তর্কালঙ্কারও অতিশয় অভিমানী প্রকৃতির লোক ছিলেন; অযাচিত, কোনমতেই ব্রাহ্মণ নিজের ও কন্যার সম্মান বিসর্জন দিয়া মেয়েকে শ্বশুরালয়ে পাঠাইতে সম্মত হইলেন না। শৈলেশ প্রবাসে থাকিতেই এই সকল ব্যাপারের কিছু কিছু শুনিয়াছিল; ভাবিয়াছিল, বাড়ি গেলেই সমস্ত ঠিক হইয়া যাইবে; কিন্তু বছর চারেক পরে যখন যথার্থই বাড়ি ফিরিল, তখন তাহার স্বভাব ও প্রকৃতি দুই-ই বদলাইয়া গেছে। অতএব আর-একজন বিলাতফেরতের বিলাতি আদবকায়দা-জানা বিদুষী মেয়ের সহিত যখন বিবাহের সম্ভাবনা হইল, তখন সে চুপ করিয়াই সম্মতি দিল। ইহার পরে বহুদিন গত হইয়াছে, শৈলেশের পিতা কালীপদবাবু মরিয়াছেন, বৃদ্ধ তর্কালঙ্কারও স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। এতকালের মধ্যে ও-বাড়ির কোন খবরই যে শৈলেশের কানে যায় নাই তাহা নহে। সে ভায়েদের সংসারে আছে, জপতপ, পূজা-অর্চনা, গঙ্গাজল ও গোবর লইয়া কাটিতেছে—তাহার শুচিতার পাগলামিতে ভায়েরা পর্যন্ত অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে। ইহার কোনটাই তাহার শ্রুতিসুখকর নহে; কেবল একটু সান্ত্বনা এই ছিল যে, এই প্রকৃতির নারীদের চরিত্রের দোষ বড় কেহ দেয় না। দিলে শৈলেশের কতখানি লাগিত বলা কঠিন, কিন্তু এ দুর্নামের আভাসমাত্রও কোন সূত্রে আজও তাহাকে শুনিতে হয় নাই।

0 Shares