লোহার বিস্কুট

কমলবাবু বললেন, ‘আমি পাড়াতেই থাকি, হিন্দুস্থান পার্কের কিনারায়। আপনাকে অনেকবার দেখেছি, আলাপ করবার ইচ্ছে হয়েছে কিন্তু সাহস হয়নি। আজ একটা সূত্র পেয়েছি, তাই ভাবলাম এই ছুতোয় আলাপটা করে নিই। আমার জীবনে একটা ছোট্ট সমস্যা এসেছে–‘

‘সমস্যা!’ ব্যোমকেশ সিগারেটের কৌটো এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বলুন বলুন, অনেকদিন ও বস্তুর মুখদর্শন করিনি।’

গ্রীষ্মের একটি রবিবার সকালে ব্যোমকেশের কেয়াতলার বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল। কমলবাবুর চেহারাটি নাড়ুগোপালের মত, কিন্তু মুখের ভাব চটপটে বুদ্ধিসমৃদ্ধ। তিনি হাসিমুখে একটি সিগারেট নিয়ে ধরালেন, তারপর গল্প আরম্ভ করলেন, ‘আমার নাম কমলকৃষ্ণ দাস, কাছেই ভারত কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের শাখা আছে, আমি সেখানকার ক্যাশিয়ার। বছর দেড়েক আছে পুরুলিয়া থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছি।

‘কলকাতায় এসেই মুশকিলে পড়ে গেলাম; কোথাও বাসা খুঁজে পাই না। শেষ পর্যন্ত একটি লোক তার বাড়ির নীচের তলায় একটি ঘর ছেড়ে দিল। ফ্যামিলি আনা হল না, স্ত্রী আর মেয়েকে পুরুলিয়ায় রেখে একলা বাসায় উঠলাম।

‘বাড়িওয়ালার নাম অক্ষয় মণ্ডল। বাড়িটি দোতলা; নীচের তলায় দু’টি ঘর, ওপরে দু’টি; যাতায়াতের রাস্তা আলাদা। অক্ষয় মণ্ডল দোতলায় একলা থাকে, কিন্তু তার কাছে লোকজনের যাতায়াত আছে। মিষ্টভাষী লোক, কিন্তু কী কাজ করে বুঝতে পারলাম না। মাঝে মাঝে আমার ঘরে এসে গল্পসল্প করত, কিন্তু আমাকে কোনদিন দোতলায় ডাকত না পড়শীদের সঙ্গেও যাতায়াত ছিল না। আমাদের ব্যাঙ্কে ওর একটা চালু খাতা ছিল।

‘যাহোক, এইভাবে মাস তিনেক কাটার পর একদিন একটা ছুটির দিনে আমার অফিসের একজন সহকর্মী বন্ধুর বাড়িতে রাত্রে নেমন্তন্ন ছিল। ফিরতে রাত হয়ে গেল। বাসায় ফিরে দেখি অক্ষয় মণ্ডল দোতলা থেকে নেমে এসে সিঁড়ির দরজায় তালা লাগাচ্ছে, তার পায়ের দু’পাশে দু’টি সুটকেশ। বললাম, “একি, এত রাত্রে কোথায় চললেন?”

‘আমায় দেখে অক্ষয় মণ্ডল কেমন হকচকিয়ে গেল; তারপর সুটকেশ দুটো দু’হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল, একটু গাঢ় গলায় বলল, “কমলবাবু, আমাকে হঠাৎ বাইরে যেতে হচ্ছে। কবে ফিরব কিছু ঠিক নেই।”

‘দেখলাম তার চোখ দুটো লাল হয়ে রয়েছে। বললাম, ‘সে কি, কোথায় যাচ্ছেন?”

‘তার মুখে হাসির মত একটা ভাব ফুটে উঠল। সে বলল, “অনেক দূর। আচ্ছা, চলি।”

‘আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে কয়েক পা গিয়ে থমকে দাঁড়াল, তারপর ফিরে এসে বলল, “কমলবাবু, আপনি সজ্জন, ব্যাঙ্কে চাকরি করে; আপনাকে একটা কথা বলে যাই। সাত দিনের মধ্যে আমি যদি ফিরে না আসি, আপনি আমার পুরো বাড়িটা দখল করবেন। আপনাদের ব্যাঙ্কে আমার অ্যাকাউণ্ট আছে, মাসে মাসে দেড়শো টাকা ভাড়া আমার খাতায় জমা দেবেন।–আচ্ছা।”

‘অক্ষয় মণ্ডল চলে গেল। আমি স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বিস্ময়ের চটকা ভেঙে খেয়াল হল, অক্ষয় মণ্ডল তার দোরের চাবি আমাকে দিয়ে যায়নি।

‘সে যাহোক, আস্ত বাড়িটা পাওয়া যেতে পারে এই আশায় মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল। মনে হল অক্ষয় মণ্ডল অগস্ত্য যাত্রা করেছে, আর শীগ্‌গির ফিরবে না।

‘পরদিন সকালে স্ত্রীকে চিঠি লিখে দিলাম–সংসার গুটিয়ে তৈরী থাকো, বাসা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

‘আশায় আশায় দুটো দিন কেটে গেল। তিনি দিনের দিন গন্ধ বেরুতে আরম্ভ করল। বিকট গন্ধ, মড়া-পচা গন্ধ। গরমের দিনে মাছ মাংস পচে গিয়ে যে-রকম গন্ধ বেরোয় সেই রকম গন্ধ আসছে।

‘সন্দেহ হল, পুলিসে খবর দিলাম। পুলিস এসে তালা ভেঙে ওপরে উঠল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। গিয়ে দেখি বীভৎস কাণ্ড। ঘরের মেঝের ওপর একটা মড়া হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে, তার কপালে একটা ফুটো। সে-রাত্রে আমি যখন নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম, সেই সময় অক্ষয় মণ্ডল লোকটাকে গুলি করেছে, তারপর দামী জিনিসপত্র টাকাকড়ি সুটকেশে পুরে নিয়ে কেটে পড়েছে।

‘দেখতে দেখতে একপাল পুলিস এসে বাড়ি ঘিরে ফেলল। লাশ ময়না তদন্তের জন্যে পাঠানো হল। দারোগাবাবু আমাকে জেরা করলেন। তারপর খানাতল্লাশ আরম্ভ হল। নিরপেক্ষ সাক্ষী হিসাবে পাড়ার একটি ভদ্রলোক এবং আমি সঙ্গে রইলাম।

‘খানাতল্লাশে কিন্তু বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। কেবল একটা দেরাজের মধ্যে কয়েকটা লোহার পাত দিয়ে তৈরী কৌটোর মত জিনিস পাওয়া গেল; সিগারেটের প্যাকেটে রুপোলি তবকের মধ্যে যেমন সিগারেট মোড়া থাকে, অনেকটা সেই রকম লম্বাটে ধরনের তবক, খুব পাতলা লোহা দিয়ে তৈরী, কিন্তু অভ্যন্তর ভাগ শূন্য। দারোগাবাবু সেগুলো নিয়ে চিন্তিতভাবে নাড়াচাড়া করলেন, কিন্তু হালকা লোহার মোড়ক কোন্‌ কাজে লাগে বোঝা গেল না।

‘যাহোক, সেদিনকার মত তদন্ত শেষ হল, পুলিস চলে গেল। আমার মনে কিন্তু অস্বস্তি লেগে রইল। তিন-চার দিন পরে থানায় গেলাম। সেখানে গিয়ে খবর পেলাম মৃত ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে; আঙুলের ছাপ ও অন্যান্য দৈহিক চিহ্ন থেকে প্রকাশ পেয়েছে যে মৃত ব্যক্তির নাম হরিহর সিং; দাগী আসামী ছিল, মাদকদ্রব্য এবং সোনা-রূপোর চোরাকারবার করত। অক্ষয় মণ্ডলের সঙ্গে কোন্‌ সূত্রে তার যাতায়াত ছিল, তা জানা যায়নি। অক্ষয় মণ্ডলের নামে হুলিয়া জারী হয়েছে; কিন্তু সে এখনো ধরা পড়েনি, কর্পূরের মত উবে গেছে।

‘থানা থেকে ফেরার সময় ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম, “পুরো বাড়িটা তাহলে আমি দখল করতে পারি?”

‘দারোগাবাবু বললেন, “স্বচ্ছন্দে। আসামী যখন ফেরার হবার আগে আপনাকে তার বাড়ির হেপাজতে রেখে গেছে, তখন আপনি থাকবেন বৈকি। তবে একটা কথা, যদি আসামীর সাড়াশব্দ পান, তৎক্ষণাৎ থানায় খবর দেবেন”

0 Shares