বহ্নি-পতঙ্গ

‘পাটনায় পৌঁছিয়া দশ-বারো দিন বেশ নিরুপদ্রবে। কাটিল। তারপর একদিন পুরন্দর পাণ্ডের সহিত দেখা হইয়া গেল। পাণ্ডেজি বছরখানেক হইল বদলি হইয়া পাটনায় আসিয়াছেন। সেই যে দুর্গরহস্য সম্পর্কে তাঁহার সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম‌, তারপর আর দেখা হয় নাই। পাণ্ডেজি খুশি হইলেন‌, আমরাও কম খুশি হইলাম না। পাণ্ডেজি মৃত্যু-রহস্যের অগ্রদূত‌, আমাদের সহিত দেখা হইবার দু’ একদিন পরেই একটি রহস্যময় মৃত্যু আসিয়া উপস্থিত হইল এবং—’

আদিম রিপুতে যে মৃত্যু-রহস্যের উল্লেখ করিয়াছিলাম তাঁহাই এখন সবিস্তারে লিপিবদ্ধ করিতেছি।–-

একদিন সন্ধ্যার পর পাণ্ডেজির বাসায় আড্ডা বসিয়াছিল। বাহিরের লোক কেহ ছিল না‌, কেবল ব্যোমকেশ‌, পাণ্ডেজি ও আমি। চা‌, কাবুলী মটরের ঘুগনি‌, মনেরোর লাড়ু এবং গয়ার তামাক—এই চতুৰ্বর্গের সহযোগে পুরাতন স্মৃতিকথার রোমন্থন চলিতেছিল। ভূত্য মাঝে মাঝে আসিয়া গড়গড়ার কলিকা বদলাইয়া দিয়া যাইতেছিল।

পাণ্ডেজির সহিত সাক্ষাৎ হইবার পর হইতে প্ৰায় রোজই আমাদের আডডা জমিতেছে‌, কখনও আমাদের বাসায়‌, কখনও পাণ্ডেজির বাসায়। আজ পাণ্ডেজির বাসায় আডডা জমিয়াছে। তিনি আগামীকল্য আমাদের নৈশ ভোজনের নিমন্ত্বণ করিয়াছেন‌, মুগীর কাশ্মীরী কোমা খাওয়াইবেন। আমাদের কর্মহীন পাটনা প্রবাস মধুময় হইয়া উঠিয়াছে।

নাই। মহাযুদ্ধের চিতা নিভিলেও আকাশ বাতাস চিতাভস্মে আচ্ছন্ন‌, তদুপরি স্বাধীনতার প্রসব যন্ত্রণা। আমাদের স্মৃতি-রোমন্থন ঐতিহাসিক রীতিতে বর্তমান কালে নামিয়া আসিল। পাণ্ডেজি সাম্প্রতিক কয়েকটি লোমহর্ষণ সত্যঘটনা আমাদের শুনাইলেন। অবশেষে বলিলেন,–

‘এই মহাযুদ্ধের সময় থেকে পৃথিবীতে ঠগ-জোচ্চোর-খুন-বদমায়েসের সংখ্যা বেড়ে গেছে‌, সঙ্গে সঙ্গে পুলিসেরও কাজ বেড়েছে। আগে যে-সব অপরাধ আমরা কল্পনা করতাম না সেইসব অপরাধ নিত্য-নিয়ত ঘটছে। বিদেশী সিপাহীরা এসে নানা রকম বিজাতীয় বজ্জাতি শিখিয়ে গেছে। কত রকম নেশার জিনিস‌, কত রকম বিষ যে দেশে ঢুকেছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এই সেদিন পাটনার এক অতি সাধারণ ছিচকে চোরের কাছ থেকে এক শিশি ওষুধ বেরুল‌, পরীক্ষা করে দেখা গেল সেটা একটা সাংঘাতিক বিষ‌, দক্ষিণ আমেরিকায় তার জন্মস্থান।’

ব্যোমকেশ গড়গড়ার নল মুখের নিকট হইতে সরাইয়া অলস কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কী বিষ? কিউরারি?’

‘হ্যাঁ। আপনি নাম জানেন দেখছি। এমন সাংঘাতিক বিষ যে রক্তের সঙ্গে এক বিন্দু মিশলে ভৎক্ষণাৎ মৃত্যু। যে শিশিটা পাওয়া গেছে তা দিয়ে সমস্ত পাটনা শহরটাকে শেষ করে দেওয়া যাবে। ভেবে দেখুন এই রকম কত শিশি আমদানি হয়েছে।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ও বিষটা কোথাও ব্যবহার হয়েছে তার প্রমাণ পেয়েছেন নাকি?’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আমাদের দেশে কোথায় কাকে বিষ খাইয়ে মারা হচ্ছে সব খবর কি পুলিসের কানে পৌঁছয়? মড়া পোড়াবার জন্য একটা ডাক্তারের সার্টিফিকেট পর্যন্ত দরকার হয় না। নেহাৎ যারা গণ্যমান্য লোক তাদের বিষ খাওয়ালে হয়তো হৈ-চৈ হয়। তাণ্ড আত্মীয়-স্বজনের চাপা দিয়ে দেয়। অথচ আমার বিশ্বাস এ দেশে বিষ খাইয়ে মারার সংখ্যা খুব কম নয়।’

ব্যোমকেশ নিবিষ্ট মনে কিছুক্ষণ গড়গড়া টানিয়া বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, আপনারা যে এই সব বিষ আর মাদক দ্রব্য উদ্ধার করেন কোথায় যায় বলুন তো?’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘কোথায় আর যাবে? কিছুদিন আমাদের কাছে থাকে‌, তারপর হেড অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়‌, তাঁরা ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সে কতটুকু? বেশির ভাগই তো চোরাবাজারে চারিয়ে আছে। যার দরকার সে কিনে ব্যবহার করছে।’ পাণ্ডেজি একটা নিশ্বাস ফেলিলেন-‘যুদ্ধ আর রাষ্ট্রবিপ্লব সভ্য মানুষকে অসভ্য করে তোলে। তখন বিবেক বুদ্ধির মুখোশ পড়ে খসে‌, কাঁচা-খেকো জানোয়ারটি বেরিয়ে আসে। কী ঠুনকে আমাদের সভ্যতা! আসলে আমরা বর্বর।’

ব্যোমকেশ কথাটা যেন একটু তলাইয়া দেখিয়া বলিল‌, ‘আসলে আমরা বর্বরই বটে। কিন্তু যখন সভ্যতা থেকে বর্বরতায় ফিরে যাই তখন সভ্যতার একটা গুণ সঙ্গে নিয়ে যাই। মুখোশ অত সহজে খসে না পাণ্ডেজি‌, কাঁচা-খেকো জন্তুটিকে খুঁজে বার করতে সময় লাগে। বাইরে শান্ত শিষ্ট নিরীহ জীব আর ভিতরে তীক্ষু নখ দস্তু–এইটেই সবচেয়ে ভয়াবহ।’

ঘড়িতে আটটা বাজিল। শীতের রাত্রি‌, কিন্তু আমাদের গৃহে ফিরিবার বিশেষ তাড়া ছিল না। তাই পাণ্ডেজি যখন আর এক কিস্তি চায়ের প্রস্তাব করিলেন তখন আমরা আপত্তি করিলাম না। এই সময় ভূত্য প্রবেশ করিয়া বলিল‌, ইন্সপেক্টর চৌধুরী এসেছেন।’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘কে রতিকান্ত? নিয়ে এস।–আর চার পেয়ালা চা তৈরি কর।’

ভৃত্য চলিয়া গেল। ক্ষণেক পরে পুলিসের পোশাক পরা একটি যুবক প্রবেশ করিল। দীর্ঘ দৃঢ় আকৃতি‌, টকটকে রঙ‌, কাটালো মুখ‌, নীল চোখ‌, হঠাৎ সাহেব বলিয়া ভ্বম হয়। বয়স ত্ৰিশের কাছাকাছি। সে আসিয়া স্যালুটের ভঙ্গীতে ডান হাতটা একবার তুলিয়া পাণ্ডেজির পাশে আসিয়া দাঁড়াইল।

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘কি খবর‌, রতিকান্ত?’

রতিকান্ত বলিল‌, ‘হুজুর‌, একটা নেমন্তন্ন চিঠি আছে।’ বলিয়া ওভারকেটের পকেট হইতে একটি খাম বাহির করল। রতিকান্তর ভাষা উত্তর ভারতের বিশুদ্ধ হিন্দী ভাষা‌, বিহারের ভেজাল হিন্দি নয়।

পাণ্ডেজি স্মিতমুখে বলিলেন‌, ‘কিসের নেমন্তয়? তোমার বিয়ে নাকি?’

রতিকান্ত করুণ মুখভঙ্গী করিয়া বলিল‌, ‘আমার বিয়ে কে দেবে হুজুর? দীপনারায়ণ সিং নেমন্তন্ন করেছেন।’

0 Shares