লক্ষ্মণের শক্তিশেল

পাত্রগণ
রাম সুগ্রীব
জাম্বুবান হনুমান
সভাসদগ্ণ বানরগণ
বিভীষণ রাবণ
লক্ষ্মণ যমদূতদ্বয়
দূত যম
প্রথম দৃশ্য   |   রামের শিবির
রাম: কাল রাত্তিরে আমি একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখেছি। দেখলুম কি, রাবণ ব্যাটা একটা লম্বা তালগাছে চড়ছে। চড়তে চড়তে হঠাৎ পা পিছলে একেবারে— পপাত চ, মমার চ!
জাম্বুবান: তবে হয়তো রাবণ ব্যাটা সত্যি সত্যিই মরেছে— রাজস্বপ্ন মিথ্যা হয় না।
সকলে: হয় না, হবে না— হতে পারে না।
রাম: আমি হনুমানকে বললুম, ‘যা, ব্যাটাকে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে আয়।’ হনুমান এসে বললে কি, ‘ফেলবারও দরকার হল না— সে এক্কেবারে মরে গেছে।’
সকলে: বাঃ বাঃ!— একদম মরে গেছে— ব্যস। আর চাই কি, খুব ফুর্তি কর!
[ বাইরে গোলমাল ]
ঐ দেখ্‌ রাবণের রথ দেখা যাচ্ছে— দেখেছিস? ঐটা রাবণ, ঐ যে লাঠি কাঁধে—
সকলে: সে কি! রাবণ ব্যাটা তবু মরেনি— ব্যাটার জান্‌ তো খুব কড়া!
জাম্বুবান: এই হনুমান ব্যাটাই তো মাটি কললে— তখন রাবণকে সমুদ্রে ফেলে দিলেই গোল চুকে যেত— না, ব্যাটা বিদ্যে জাহির করতে গিয়েছে— ‘এক্কেবারে মরে গেছে’—
বিভীষণ: চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে—
[ দূতের প্রবেশ ]
সকলে: কি হে, খবর কি?
দূত: আজ্ঞে, আমি এইমাত্র আসছি—
লক্ষ্মণ: ব্যস! মস্ত খবর দিয়েছ আর কি!
জাম্বুবান: এইমাত্র আসছ? তোপ ফেলতে হবে?
রাম: আজ কি ঘটল না ঘটল সব ভালো করে গুছিয়ে বল।
দূত: আজ্ঞে, আমি চান টান করেই পুঁইশাক চচ্চড়ি আর কুমড়ো ছেঁচকি দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়েই অমনি বেরিয়েছি— অবিশ্যি আজকে পাঁজিতে কুষ্মাণ্ড ভক্ষণ নিষেধ লিখেছিল, কিন্তু কি হল জানেন? আমার কুমড়োটা পচে যাচ্ছিল কিনা—
সকলে: বাজে বকিসনে— কাজের কথা বল্‌।
দূত: হ্যাঁ—হ্যাঁ—খেয়ে উঠেই ঘণ্টা দু-তিন জিরিয়ে সেখানে গিয়ে দেখি খুব ঢাকঢোল বাজছে—ধ্যা র‍্যা র‍্যা র‍্যা র‍্যা র‍্যা—ধ্যা র‍্যা র‍্যা র‍্যা—ধ্যার‍্যা—
সকলে: মার—ব্যাটাকে মার—ব্যাটার কান কেটে দে!
জাম্বুবান: ব্যাটার ধ্যার‍্যার‍্যার‍্যা—চলেছে যেন রেকারিং ডেসিলাম!
সুগ্রীব: ব্যাটা, তুই ভালো করে ধারাবাহিকরূপে আদ্যোপান্ত পর্যায়পরম্পরা সব বলবি কি না?
রাম: তারপরে কি হল শুনি—ততঃ কিম্‌?
দূত: (গান) আসিছে রাবণ বাজে ঢক্ক ঢোল,
মহা ধুমধাম মহা হট্টগোল।
সকলে: ততঃ কিম্, ততঃ কিম্, ততঃ কিম্?
দূত: শঙ্খ হুলাহুলি সানাই নিঃস্বন
কর্তাল ঝঙ্কার অস্ত্রের ঝনন।
সকলে: ততঃ কিম্, ততঃ কিম্, ততঃ কিম্?
দূত: লাখো লাখো সৈন্য চলে সাথে সাথে
উড়িছে পতাকা সমুখে পশ্চাতে।
সকলে: ততঃ কিম্, ততঃ কিম্, ততঃ কিম্?
দূত: বীর দর্পে সবে করে কোলাহল
মহা আস্ফালনে কাঁপে ধরাতল।
সকলে: ততঃ কিম্, ততঃ কিম্, ততঃ কিম্?
দূত: তাহাদের রুদ্র দাপটের চোটে
ভয়ে প্রাণ উড়ে পিলে চমকে ওঠে।
সকলে: ততঃ কিম্, ততঃ কিম্, ততঃ কিম্?
দূত: আজি দুর্দিনেতে নাহি করো রক্ষা।
দলে বলে সবে পাবি আজি অক্কা।
জাম্বুবান: চোপরও বেয়াদব! মুখ সামলে কথা বলিস।
রাম: তুমি রাবণকে দেখেছ, এখান থেকে কত দূরে?
দূত: আজ্ঞে, এখেন থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা।
সকলে: হ্যাঁ—হ্যাঁ—পাঁচ ঘণ্টা, না পঁচিশ ঘণ্টা!
দূত: আজ্ঞে একটু দ্রুত হাঁটলে পোয়া ঘণ্টায় হতে পারে।
জাম্বুবান: তুমি কি করে আসছিলে? হামাগুড়ি দিয়ে?
রাম: কোনদিকে আসছিল, বল ত?
দূত: আজ্ঞে, তা তো জিজ্ঞেস করিনি!
সকলে: ব্যাটা! তুমি আছ কোন কর্মে?
রাম: তাড়াতাড়ি আসছিল, না আস্তে আস্তে?
দূত: আজ্ঞে, তাড়াতাড়ি—আজ্ঞে, আস্তে। আজ্ঞে—সেটা ঠিক ঠাওর করে দেখিনি!
সকলে: এটা কোথাকার অপদার্থ রে? দে, ওটাকে তাড়িয়ে দে।
বিভীষণ: (জাম্বুবানের প্রতি) মন্ত্রীমশাই! একটা কথা শুনুন! কানে কানে বলব—
জাম্বুবান: উঃ— দুৎ! বনমানুষ কোথাকার! তোর দাড়িতে ভারি গন্ধ! শুনব না—
দূত: হাঃ—হাঃ—হাঃ—হাঃ—হাঃ—
বিভীষণ: ব্যাটা হাসছিস কেন রে বেয়াদব?     [ প্রহার ও অর্ধচন্দ্র ]
সুগ্রীব: ওরে, কে কোথায় আছিস? আমার গদাটা নিয়ে আয় ত।
সকলে: কেন? গদা কেন?
সুগ্রীব: রাবণকে ঠ্যাঙাব।
[ গান ]
লিখিয়াছে ঠিক বটে পুরাতন শ্লোকে।
শাস্ত্র আদি পড়ে তবু মূর্খ হয় লোকে।।
পুঁথিগত বিদ্যে তার ভুঁড়িখানা ভরা।
পাণ্ডিত্যের অভিমানে ভ্রান্ত দেখে ধরা।।
বক্তৃতার গন্ধ পেলে গণ্ডে বহে লালা।
কূটতর্কে ত্রস্ত লোকে কর্ণ ঝালাপালা।।
সমস্বরে পরস্পরে পাড়ে গালাগালি—
মহাশব্দে বিশ্ব ফাটে কর্ণে লাগে তালি।।
লম্ফঝম্প ভঙ্গিমায় কেহ বা নাহে কম।
কারে ছেড়ে কারে দেখি সমস্যা বিষম।।
সুকার্যে উৎসাহ নাই দেহে নাই বল।
ভক্তিহীন ভণ্ড যত নিষ্কর্মার দল।।
রোগা রোগা হাতে দেখি মোটা মোটা লাঠি।
প্লীহাগ্রস্ত ভুঁড়ো পেট ঠাং যেন কাঠি।।
ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ড তাহে ভারি।
যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারী।।
[ হনুমানের প্রবেশ ]
হনুমান: রাবণ বোধহয় আসছে!
সকলে: যা—যা, ব্যাটা এতক্ষণে এক বাসি সংবাদ নিয়ে এসেছে!
সুগ্রীব: চল হে লক্ষ্মণ, আমরা যুদ্ধ করি গিয়ে—    [ সকলের উত্থান ও প্রস্থান ]
[ ইতি সমাপ্তোয়ং লক্ষ্মণের শক্তিশেলাভিধেয়সা কাব্যস্য প্রথমো সর্গঃ ]
দ্বিতীয় দৃশ্য   |   রণস্থল
[ সুগ্রীবের প্রবেশ ]
সুগ্রীব: (ভয়ে ভয়ে) কেউ নেই ত?   [ পদচারণা ]
[ বিভীষণের প্রবেশ ]
বিভীষণ: দেখ, হাঁটছে দেখ— বাঁদুরে বুদ্ধি কিনা!— দুৎ! যুদ্ধ করতে এসেছিস, ওমনি করে হাঁটলে লোকে বাঙাল বলবে যে!— এমনি করে হাঁট।   [ নমুনা প্রদর্শন ]
সুগ্রীব: রেখে দাও তোমার ভড়ং! আমাদের দেশে ওরকম হাড়গিলের মতো করে হাঁটে না।
বিভীষণ: তোদের দেশে আবার হাঁটতে জানে নাকি? আচ্ছা মানুষ ত!
সুগ্রীব: মানুষ বললে কেন হে? খামকা গালি দিচ্ছ কেন?
[ নেপথ্যে ] জাম্বুবান । ওরে তোরা পালিয়ে আয়, রাবণ আসছে।
বিভীষণ ও সুগ্রীব: অ্যাঁ—কৈ?
[ গান ]

যদি রাবণের ঘুঁষি লাগে গায়—
তবে তুই মরে যাবি—তবে তুই ম—রে—যা—বি
ওরে, পালিয়ে যারে পালিয়ে যা
তা না হলে মরে যাবি—
লগুড়ের গুঁতো খেয়ে হঠাৎ একদিন মরে যাবি।

বিভীষণ: ওরে আমার মনে পড়েছে— একটা বড্ড জরুরী কাজ বাকি আছে— সেটা চট করে সেরে আসছি।    [ প্রস্থান ]
সুগ্রীব: এইবার বোধহয় রাবণ আসবে—আজ একটা কিছু হয়ে যাবে—ইসপার নয় উসপার—
[ রাবণের প্রবেশ ]
সুগ্রীব: [ গান ]
তবেরে রাবণ ব্যাটা
তোর মুখে মারব ঝ্যাঁটা
তোরে এখন রাখ্‌বে কেটা
এবার তোরে বাঁচায় কেটা বল্‌।
(তোর) মুখের দুপাটি দন্ত
ভাঙিয়া করিব অন্ত
তোর এখনি হবে প্রাণান্ত
আয়রে ব্যাটা যমের বাড়ি চল্‌।।
রাবণ: [ গান ]ওরে পাষণ্ড, তোর ও মুণ্ড খণ্ড খণ্ড করিব।
যত অস্থি হাড়, হবে চুরমার, এমনি আছাড় মারিব।।
ব্যাটা গুলিখোর বুদ্ধি নেই তোর নেহাত তুই চ্যাংড়া।
আয় তবে আয় যষ্ঠির ঘায় করিব তোরে ল্যাংড়া।।
সুগ্রীব: রেখে দে তোর গলাবাজি
ওরে ব্যাটা ছুঁচো পাজি
অন্তিম সময়ে আজি
ইষ্টদেবে কররে নমস্কার।
তুইরে পাষণ্ড ঘোর
পাল্লায় পড়িলি মোর
উদ্ধার না দেখি তোর
মোর হাতে না পাবি নিস্তার।।
রাবণ: ওরে বেয়াদব কহিলে যে সব
ক্ষমা যোগ্য নহে কখন
তার প্রতিশোধ পাবিরে নির্বোধ
পাঠাব শমন সদন।।   [ প্রহার ]
সুগ্রীব: ওরে বাবা ইকী লাঠি
গেল বুঝি মাথা ফাটি
নিরেট গদা ইকী সর্বনেশে!
কাজ নেইরে খোঁচা খুঁচি
ছেড়ে দে ভাই কেঁদে বাঁচি
সাধের প্রাণটি হারাব কি শেষে?   [ সুগ্রীবের পলায়ন ]
রাবণ: ছি, ছি, ছি— এত গর্ব করে, এত আস্ফালন করে, শেষটায় চম্পট দিলে? শেম্‌! শেম্‌!
[ লক্ষ্মণের প্রবেশ ]
রাবণ: [ গান ]

আমার সহিত লড়াই করিতে
আগ্রহ দেখি যে নিতান্ত—
বুঝেছি এবার ওরে দুরাচার
ডেকেছে তোরে কৃতান্ত।
আমি পালোয়ান স্যান্ডো সমান
তুই ব্যাটা তার জানিস কি?
কোথায় লাগে বা কুরোপাটকিন
কোথায় রোজেদ্‌ভেনিস্কি?
এই যে অস্ত্র দেখিছ পষ্ট
শোভিছে আমার হস্তে
ইহারই প্রভাবে যমালয়ে যাবে
বানর কুল সমস্তে।
অযোদ্ধার লোকে যোদ্ধা হয়েছে
শুনে মরি আমি হাসিয়া
(আজি) দেখাব শক্তি রাখিব কীর্তি
দলে বলে সবে নাশিয়া।।
লক্ষ্মণ: [ লাঠি চালাইয়া ] হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ— হর্‌ হর্‌ হর্‌ হর্‌— মার্‌, মার্‌, মার্‌, মার্‌, মার্‌— কাট্‌ কাট্‌ কাট্‌ কাট্‌ কাট্‌ কাট্‌— [ শক্তিশেলাহত ]
লক্ষ্মণ: হা হতোস্মি!    [পতন ও মূর্ছা। রাবণ কতৃক লক্ষ্মণের পকেট লুণ্ঠন ]
[ হনুমানের প্রবেশ ]
হনুমান: অ্যাঁ! কি হচ্ছে— দেখে ফেলেছি!
[ রাবণের পলায়ন। অন্যান্য বানরগণের আগমন ]
বানরগণ: [ গান ]

অবাক কল্লে রাবণ বুড়ো—
যষ্ঠির বাড়ি সুগ্রীবে মারি
কল্লে যে তার মাথা গুঁড়ো,
অবাক কল্লে রাবণ বুড়ো।
(আহা) অতি মহাতেজা সুগ্রীব রাজা
অঙ্গদেরি চাচা খুড়ো,
অবাক কল্লে রাবণ বুড়ো।
(আরে) গদা ঘুরাইয়া দিল উড়াইয়া
লক্ষ্মণেরি ধড়া চুড়ো—
অবাক কল্লে রাবণ বুড়ো।
(ওরে) লক্ষ্মণেরে মেরে বানর দলেরে
কল্লে বেটা তাড়াহুড়ো
অবাক কল্লে রাবণ বুড়ো।
(ব্যাটা) বুদ্ধি বিপুল যুদ্ধে নিপুণ
কিন্তু ব্যাটা বেজায় ভুঁড়ো,
অবাক কল্লে রাবণ বুড়ো।।
[ লক্ষ্মণকে লইয়া প্রস্থান ]
[ সমাপ্তোয়ং লক্ষ্মণের শক্তিশেলাভিধেয়স্য কাব্যস্য দ্বিতীয়ো সর্গঃ ]
তৃতীয় দৃশ্য   |   রামচন্দ্রের শিবির
রাম: কিছু আগে একটা গোলমাল শোনা যাচ্ছিল— বোধহয় কোথাও যুদ্ধ বেধে থাকবে।
বিভীষণ: তা হবে!
[ খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে ব্যান্ডেজ বদ্ধ সুগ্রীবের সকাতর প্রবেশ ]
বিভীষণ: আরে ও পালওয়ানজি, একি হল— ষাট্‌ ষাট্‌ ষাট্‌।   [ সকলের উচ্চহাস্য ]
রাম: কি হে সুগ্রীব, তোমার যে দেখছি বহ্বারম্ভে লঘু ক্রিয়া হল।
বিভীষণ: আজ্ঞে, বজ্র আঁটুনি ফস্‌কা গেরো—
রাম: যত তেজ বুঝি তোমার মুখেই।
জাম্বুবান: আজ্ঞে হ্যাঁ, মুখেন মারিতং জগৎ।
রাম: আমি বলি কি তুমি মস্ত যোদ্ধা।
জাম্বুবান: যোদ্ধা ব’লে যোদ্ধা—ঢাল নেই তলোয়ার নেই খামচা মারেঙ্গা।
বিভীষণ: আমি বরাবরই বলে আসছি—
সুগ্রীব: দ্যাখ! তোর ঘ্যান্‌ঘ্যানানি আমার ভালো লাগে না—
রাম: রাবণের কেন বল এত বাড়াবাড়ি?—
পিঁপড়ের পাখা উঠে মরিবার তরে।
জোনাকি যেমতি হায়, অগ্নিপানে রুষি
সম্বরে খদ্যোত লীলা—
জাম্বুবান: আজ্ঞে ঠিক কথা—
রাঘব বোয়াল যবে লভে অবসর
বিশ্রামের তরে— তখনি তো মাথা তুলি
চ্যাংড়া পুঁটি যত করে মহা আস্ফালন।
[ বাইরে গোলমাল ]
রাম: এত গোলমাল কিসের হে?
সুগ্রীব: রাবণ ইদিকে আসছে না ত?
জাম্বুবান ও বিভীষণ: অ্যাঁ—রাবণ আসছে—অ্যাঁ?
বিভীষণ: আমার ছাতাটা কোথায় গেল? ব্যাগটা?
জাম্বুবান: হ্যাঁরে তোর গায়ে জোর আছে? আমায় কাঁধে নিতে পারবি?
[ জাম্বুবানের বিভীষণের কাঁধে চাপিবার চেষ্টা ও দূতের প্রবেশ ]
দূত: শ্রীমান লক্ষ্মণ আসছেন।
[ সকলে আশ্বস্ত ]
রাম: অত হল্লা করে আসছে কেন? চেঁচাতে বারণ কর্‌।
দূত: আজ্ঞে, তিনি আসছেন ঠিক নয়—তবে হ্যাঁ, এক রকম আসছেনই বটে—মানে, তাঁকে নিয়ে আসছে।
জাম্বুবান: লোকটার কান মলে তাড়িয়ে দাও ত—ব্যাটা হেঁয়ালি পাকাবার আর জায়গা পায়নি!
[ লক্ষ্মণকে ধরাধরি করিয়া সকলের প্রবেশ ও গান ]
বললেন যাহা জাম্বুবান (সাবাস গনৎকার হে)
আনুপূর্বিক ঘটল তাহা শুনতে চমৎকার হে।
পড়লেন লক্ষ্মণ শক্তিশেলে (যেন) ঝড়ে কলাগাছ রে—
খাবি খেতে লাগলেন যেন ড্যাঙায় বোয়াল মাছ রে!
অনেক কষ্টে রৈল বেঁচে— (আহা) কপাল জোরে মৈল না—
(ওরে) স্বর্গ হৈতে কিচ্ছু তবু পুষ্পবৃষ্টি হৈল না!
ভাগ্যে মোরা সবাই সেথা ছিলাম উপস্থিত গো—
তা নৈলে ত ঘটত আজি হিতে বিপরীত গো!
রাম: হায়, হায়, হায়, হায়— হায় কি হল, হায় কি হল, হায় কি হল, হায় হায় হায়—   [ মূর্ছা ]
বানরগণ: হায়-হায়-হায়-হায়-হায়-হায়, হায়-হায়-হায়-হায়-হায়-হায়, হায় কি হল— হল-হল-হল-হল, হায় কি হল-হল-হল-হল-হল (ইত্যাদি)।
[ বানরগণের মাঝে-মাঝে কলা ভক্ষণ ]
জাম্বুবান: এতগুলো লোক কি সেখানে ঘোড়ার ঘাস কাটছিল নাকি?
সুগ্রীব: হনুমান ব্যাটা কি কচ্ছিল?
হনুমান: আমি বাতাস খাচ্ছিলুম।
সুগ্রীব: ব্যাটা, তুমি বাতাসা খাওয়ার আর সময় পাও নি!
[ গান ]

শোনরে ওরে হনুমান হওরে ব্যাটা সাবধান
আগে হতে পষ্ট ব’লে রাখি।
তুই ব্যাটা জানোয়ার নিষ্কর্মার অবতার
কাজে কর্মে দিস বড় ফাঁকি।।
কাজ কর্ম ছেড়ে ছুড়ে ঘুমোস খালি প’ড়ে প’ড়ে
অকাতরে নাকে দিয়ে তৈল—
শোন্‌রে আদেশ মোর এই দণ্ডে আজি তোর
অষ্ট আনা জরিমানা হৈল।
হনুমান: (জনান্তিকে) মোটে আট আনা?
বিভীষণ: তারপর, তোমাদের মৎলব কি স্থির হল?
সুগ্রীব: এইবার সবাই মিলে রাবণ ব্যাটাকে কিছু শিক্ষা দিতে হবে।
সকলে: হ্যাঁ, হ্যাঁ! ঠিক কথা! ঠিক কথা!
[ জাম্বুবানের নিদ্রা। সকলের গান ]
রাবণ ব্যাটায় মারো, সবাই রাবণ ব্যাটায় মারো
(তার) মাথায় ঢেলে ঘোল (তারে) উল্টো গাধায় তোল
(তার) কানের কাছে পিটতে থাকো চোদ্দ হাজার ঢোল।।
কাজ কি ব্যাটার বেঁচে (তার) চুল দাড়ি গোঁফ চেঁচে
নস্যি ঢোকাও নাকে, ব্যাটা মরুক হেঁচে হেঁচে।
(তার) গালে দাও চুন কালি (তারে) চিমটি কাটো খালি
(তার) চোদ্দপুরুষ উড়িয়ে দাও পেড়ে গালাগালি।
(তারে) নাকাল কর আরো যে যেরকম পারো
রাবণ ব্যাটায় মারো, সবাই রাবণ ব্যাটায় মারো।।
[ রামচন্দ্রের মূর্ছাভঙ্গ ও গাত্রোত্থান ]
বিভীষণ: এই যে, শ্রীরামচন্দ্র গাত্রোৎপাটন করেছেন!
রাম: তারপরে—ওষুধপত্রের কি ব্যবস্থা কললে?
সকলে: ঐ যা! ওষুধপত্রের ত কিছু ব্যবস্থা হল না?
রাম: মন্ত্রীমশাই গেলেন কোথা?
বিভীষণ: মন্ত্রীমশাই—একটু ঘুমোচ্ছেন।
সুগ্রীব: ব্যস! তবেই কেল্লা ফতে করেছেন আর কি!
সকলে: মন্ত্রীমশাই! আরে ও মন্ত্রীমশাই, আহা একবার উঠুন না!     [ ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি ]
বিভীষণ: বাবা! এ যে কুম্ভকর্ণের এক কাটি বাড়া!
জাম্বুবান: (সহসা জাগিয়া) হ্যাঁরে, আমার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিলি, ব্যাটা বেল্লিক, বেরসিক, বেয়াক্কেল, বেয়াদব—হাঁড়িমুখো ভূত!
সকলে: রাগ করবেন না— আহা রাগ করবেন না! কথাটা শুনুন।
[ গান ]
আজকে মন্ত্রীমশাই জাম্বুবানের বুদ্ধি কেন খুলছে না?
সঙ্কটকালে চটপট কেন যুক্তির কথা বলছে না?
সর্বকর্মে অষ্টরম্ভা হর্দম পড়ে নাক ডাকছে—
উল্টে কিছু বলতে গেলে বিট্‌কেল বিট্‌কেল গাল পাড়ছে।
মরছে লক্ষ্মণ জানছে তবু দেখছে চেয়ে নিশ্চিন্তে
এমনি স্বভাব ছিল না তার থাকতাম যখন কিষ্কিন্ধে।
হ্যাঙ্গাম দেখে হট্‌লে পরে নিন্দুক লোকে বলবে কি?
ভেবেই দেখ এমনি করলে রাজ্যের কার্য চলবে কি?
মুখ্যু মোরা আক্কেল শূন্য এক্কেবারেই বুদ্ধি নেই—
সূক্ষ্মযুক্তি বলতে কারো ঠাকুদ্দাদার সাধ্যি নেই।
বলছি মোরা কিচ্ছু নেইকো চট্‌বার কথা এর মধ্যে
উঠে একবার ব্যবস্থা দেও প্রণাম করি ঠাং পদ্মে।।
হনুমান: (জনান্তিকে) হ্যাঁরে, আমার লেজে পাড়িয়ে দিলি?
রাম: বুঝলে হে জাম্বুবান, তুমি কিনা হচ্ছ প্রবীণ লোক—এ-সম্বন্ধে নিশ্চয়ই তোমার খুব অভিজ্ঞতা আছে—
জাম্বুবান: আজ্ঞে হ্যাঁ— সে কথা আগে বললেই হত—তা না ব্যাটারা খালি ধাক্কাই মারছে—’মন্ত্রীমশাই, আরে ও মন্ত্রীমশাই’—আমি বলি বুঝি ডাকাত পড়ল নাকি?
রাম: হ্যাঁ, এইবার একটা কিছু ব্যবস্থা দিয়ে ফেল।
জাম্বুবান: (হনুমানের প্রতি) এই কাগজে যা প্রেসক্রিপশান লিখে দিচ্ছি, এই ওষুধগুলো চট করে নিয়ে আসতে হবে।
হনুমান: আচ্ছা, কাল ভোর না হতে উঠে নিয়ে আসব।
জাম্বুবান: না, না, এত দেরি করতে হবে না— এখুনি যা।
হনুমান: আবার এত রাত্তিরে কোথায় যাব? সাপে কাটবে না বাঘে ধরবে।
সুগ্রীব: ব্যাটা, শখের প্রাণ গড়ের মাঠ।
জাম্বুবান: না, ওষুধগুলো এখনই দরকার।
হনুমান: আঃ। হোমিওপ্যাথি লাগাও না।
জাম্বুবান: যা বলছি শোন্‌। এই যা গাছের কথা লিখলাম— বিশল্যকরণী মৃত সঞ্জীবনী— এই সব গাছের শেকড় আনতে হবে।
হনুমান: আমি ডাক্তারখানা চিনিনে।
জাম্বুবান: আ মরণ আর কি! একি কলকেতার শহর পেয়েছিস নাকি যে, বাথগেট কোম্পানি তোর জন্যে দোকান খুসে বসবে? কৈলাস পাহাড়ের কাছে গন্ধমাদন পাহাড় আছে জানিস ত?
হনুমান: কৈলেস ডাক্তার আবার কে?
জাম্বুবান: বাস! কানের পটহটা দেখি ভারি সরেস— ব্যাটা, কৈলেস পাহাড় জানিসনে?
হনুমান: ও বাবা! সেই কৈলেস পাহাড়! এত রাত্তিরে আমি অত দূর যেতে পারব না।
জাম্বুবান: যাবিনে কি রে ব্যাটা? জুতিয়ে লাল করে দেব। এখুনি যা— দেখিস পথে মেলা দেরি করিসনে।
হনুমান: আমার কান কটকট কচ্ছে—
রাম: আহা, যারে যা, আর গোল করিসনে— নে বকশিশ নে।   [ কলা প্রদান ]
হনুমান: যো হুকুম।   [ কুর্নিশ করিতে করিতে প্রস্থান ]
জাম্বুবান: তারপর রাত্তিরের জন্য একজন সেনাপতি নির্বাচন কর।
রাম: কেন? রাত্তিরে যুদ্ধ করবে নাকি?
জাম্বুবান: তা কেন? একজনকে একটু খবরদারি করতে হবে ত! তা ছাড়া, হয়ত লক্ষ্মণকে নিয়ে যমদূতগুলোর সঙ্গে ঝগড়া করতে হতে পারে।
সকলে: তা ত বটেই! মন্ত্রীমশাই না হলে এমন বুদ্ধি কার হয়?
সুগ্রীব: (স্বগত) হ্যাঁ হ্যাঁ, এইবার ভায়া বিভীষণকে কিঞ্চিৎ ফাঁপরে ফেলতে হচ্ছে—
[ গান ]
আমার বচন শুন বিভীষণ করহ গ্রহণ সেনাপতি পদ
(আহা) সাজ সজ্জা কর, দিব্য অস্ত্র ধর সমরে সম্বর এ মহা বিপদ
(তুমি) বিপদে নির্ভীক বীর্যে অলৌকিক তোমার অধিক কেবা আছে আর
(আহা) জলেতে পাষাণ যায় গো ভাসান মুশকিলে আসান প্রসাদে তোমার—
সকলে: ঠিক কথা— উত্তম কথা।
বিভীষণ: তাই ত! মুশকিলে ফেললে দেখছি।
সুগ্রীব: শুন সর্বজনে আজিকে এক্ষণে বীর বিভীষণে কর সেনাপতি
(আহা) শ্রীরামের তরে সম্মুখ সমরে যদি যায় মরে কিবা তাহে ক্ষতি?
সকলে: তা ত বটেই— কিচ্ছু ক্ষতি নেই।
জাম্বুবান: বেশ ত! তাহলে তাই ঠিক হল— খবরদার। দেখ, ভালো করে পাহারা দিও। কোনো ব্যাটাকে পথ ছাড়বে না— স্বয়ং যম এলেও নয়। — আর দেখ যেন ঘুমিও না।     [ বিভীষণ ব্যাতির সকলের প্রস্থান ]
বিভীষণ: ইকী গেরো! আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল দেখছি!
[ গান ]
বিধি মোর ভালে হায় কি লিখিল
আজ রাত্রে একি বিপদ ঘটিল।
দুর্মতি সুগ্রীব চির শত্রু মোর
ফেলিল আমারে সঙ্কটেতে ঘোর।
জাম্বুবান ব্যাটা কুবুদ্ধির ঢেঁকি
তার চক্রে পড়ি নিস্তার না দেখি।
আসে যদি কেহ রাত্রি দ্বিপ্রহরে—
ঠেকাব কেমনে একাকী তাহারে?
স্বর্গ হতে কহ দেবগণ সবে
আজি এ সঙ্কটে কি উপায় হবে?
যম হস্তে আজি না দেখি নিস্তার
সুযুক্তি তাহার কহ সবিস্তার
শুন দেবাসুর গন্ধর্ব কিন্নর—
মানব দানব রাক্ষস বানর।
শুন সর্বজনে মোর মৃত্যু হলে
শোকসভা ক’রো তোমরা সকলে।
[ সমাপ্তোয়ং লক্ষ্মণের শক্তিশেলাভিধেয়স্য কাব্যস্য তৃতীয়ো সর্গঃ ]
চতুর্থ দৃশ্য   |   শিবির প্রাঙ্গণ
[ বিভীষণের পাহারাদারি— মধ্যে মধ্যে আয়নায় মুখাবলোকন ইত্যাদি ]
বিভীষণ: জাম্বুবান বলছিলেন, ‘দেখো যেন ঘুমিও না’— বাপু, এমন অবস্থায় পড়ে যিনি ঘুম দিতে পারেন, তাঁকে আমি পাঁচশো টাকা বকশিশ দিতে পারি!
[ পদচারণা ও উঁকি-ঝুঁকি ]
তবে এ-পর্যন্ত যখন কোনো দুর্ঘটনা হয়নি— তাতে আমার কিছু কিছু ভরসা হচ্ছে— চাই কি, হয়ত বিনা গোলযোগে রাত কাবার হয়ে যেতে পারে। …যাক! একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক— যমের ত ইদিকে আসবার কোনোই গতিক দেখছি না— আর, আসলেই বা কি? তাকে বাধা দেওয়াটা ত আর বুদ্ধিমানের কার্য হবে না!
[ উপবেশন ও অচিরাৎ নিদ্রা। জাম্বুবানের প্রবেশ ]
জাম্বুবান: দেখেছ, আধ ঘণ্টা না যেতেই ঘঁৎ ঘঁৎ করে নাক ডাকতে আরম্ভ করেছে— ওরে বিভীষণ (খোঁচা দিয়ে) ওঠ্‌!
বিভিষণ: (লাফাইয়া উঠিয়া) কেরে! ও— জাম্বুবান যে— তুই বুঝি মনে করেছিলি আমি ঘুমিয়ে পড়েছি? আমি কিন্তু সত্যি করে ঘুমোইনি।
জাম্বুবান: হ্যাঁ— হ্যাঁ— আমায় আর সমঝাতে হবে না। দিব্যি পড়ে নাক ডাকছে— আবার বলে, ‘সত্যি করে ঘুমোইনি।’
বিভীষণ: তুই টের পাসনি?— আমি মিট্‌মিট্‌ করে চেয়ে দেখছিলাম।
জাম্বুবান: না না— মিট্‌মিট্‌ করে দেখলে চলবে না— ভালো করে পাহারা দিতে হবে।    [ প্রস্থান ]
বিভীষণ: ব্যাটা ত ভারি জোচ্চোর! আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিল।    [ পুনরুপবেশন ও পুনর্নিদ্রা ]
[ যমদূতদ্বয়ের প্রবেশ ]
প্রথম দূত: হ্যাঁরে, বাড়িটা ঠিক চিনে এসেছিস তো?
দ্বিতীয় দূত: আরে, হাঁরে, হাঁ, এতদিন কাজ করেছি; একটা বাড়ি চিনতে পারব না?
প্রথম দূত: তোকে কি বাৎলিয়ে দিয়েছিল বল্‌ ত?
দ্বিতীয় দূত: আমাকে বলে দিয়েছে, যে, “সেই ডানদিকের উঠোনওয়ালা বাড়িটায় যাবি।”
প্রথম দূত: ডানদিক ত এই— আর উঠোনকে উঠোন মিলে গেছে, তবে ত ঠিকই এসেছি—
দ্বিতীয় দূত: হ্যাঁ, চল— মড়াটা খুঁজে দেখি!    [ অন্বেষণ করিতে করিতে বিভীষণোপরি পতন ]
বিভীষণ: কেরে! কেরে!
প্রথম ও দ্বিতীয় দূত: [ লাফাইয়া তিন হাত দূরে গিয়া ]   এটা কি আছে রে! এটা কি আছে রে!
দ্বিতীয় দূত: ও বাপ্পো—এ মানুস্‌ আছে নাকি?
প্রথম ও দ্বিতীয় দূত: ও বাপ্পো— মানুস্‌? জীয়ন্ত মানুস্‌?  [ ভয়ে কম্পিত ]
দ্বিতীয় দূত: কৈ রে কিছু ত বলছে না!
প্রথম দূত: তাহলে বোধহয় কিছু বলবে না।
দ্বিতীয় দূত: হ্যাঁ, বেশ অমায়িক চেহারা! ওকে জিজ্ঞেস কর ত?
প্রথম দূত: তুই জিজ্ঞেস কর!
দ্বিতীয় দূত: তুই জিজ্ঞেস কর না! আমি তোকে ধরে থাকব—
প্রথম দূত: মশাই গো—মশাই—শুনুন মশাই—একটু পথ ছেড়ে দেবেন মশাই?
দ্বিতীয় দূত: আমরা মশাই— গরীব বেচারা মশাই—
বিভীষণ: (স্বগত) এ ত মজা মন্দ নয়! এরা দেখছি আমার ভয়ে থরথরি কম্পমান।
প্রথম দূত: চল একটু পাশ কটিয়ে চলে যাই!    [ পাশ কাটিয়া যাইবার উদ্যোগ ]
প্রথম ও দ্বিতীয় দূত: ওরে নারে, চোখ রাঙাচ্ছে—
[ গান ]
দয়াবান গুণবান ভাগ্যবান মশাই গো
তোমার প্রাণে একটুও কি দয়ামায়া নাই গো
তোমার তুল্য খাঁটি বন্ধু আর কাহারে পাই গো?
তুমি ভরসা নাহি দিলে অন্য কোথা যাই গো!
এ সময়ে তোমা ভিন্ন কে আছে সহায় গো—
কার্যোদ্ধার না হলে ত না দেখি উপায় গো।
পথ ছেড়ে দাও মুক্ত কণ্ঠে তোমার গুণ গাই গো
দয়াবান গুণবান ভাগ্যবান মশাই গো।।
বিভীষণ: ভাগ্‌ ব্যাটারা, নইলে একেবারে প্রহারেন ধনঞ্জয় করে দেব।
[ উভয় দূতের পলায়ন ও পুনঃপ্রবেশ ]
প্রথম দূত: হ্যাঁরে, পালাচ্ছিস কোথা? খালি হাতে গেলে যমরাজা কাউকে আস্ত রাখবে না।
দ্বিতীয় দূত: তাই ত! তাই ত! এ ত ভারি মুশকিল হল—কি করা যায় বল্‌ দেখি?
প্রথম দূত: আয় না, আমরাও ব্যাটার সঙ্গে লড়াই করি গিয়ে।
দ্বিতীয় দূত: [ গান ]
“যখন পরাজয় খলু অনিবার্য
তখন যুদ্ধ কি বুদ্ধির কার্য?”
প্রথম দূত: তবে তো মুশকিল উপায় কি হবে?
সাধ করে কেবল প্রাণটা হারাবে?
দ্বিতীয় দূত: আমিও তাই বলি লড়ায়ে কাজ নাই—
কাজেতে ইস্তফা এখনি দাও ভাই!
প্রথম ও দ্বিতীয় দূত: হায় কি ঘটিল হায় কি ঘটিল
এমন সাধের চাকুরি ঘুচিল!
বিভীষণ: ব্যাটারা রাত দুপুরে গান জুড়েছিস—চাবকিয়ে রোগা করে দেব।
[ দূতদ্বয় প্রস্থানোদ্যত ও দ্বারদেশে যমসহ সাক্ষাৎ ]
প্রথম ও দ্বিতীয় দূত: দোহাই মহারাজ, দোহাই যমরাজা, আমাদের কিছু দোষ নেই— ওই এক ব্যাটা আমাদের পথ ছাড়ছে না।
[ যমের প্রবেশ ]
বিভীষণ: এই মাটি করেছে— এখন উপায়? আটকাতে গেলে যম মারবে, না আটকালে রাম মারবে। উভয় সঙ্কট! যা থাকে কপালে, ব্যাটাকে পথ ছাড়ব না। (সদর্পে) তবে রে ব্যাটা— আমায় চিনিসনে? আমি থাকতে তুই ঢুকবি?
[ যমের অগ্রসর হওয়া ]
দ্বিতীয় দূত: ওরে এবার লড়াই বাধবে—
প্রথম দূত: হ্যাঁরে ভারি মজা দেখা যাবে—
দ্বিতীয় দূত: (বিভীষণের) পালা, পালা— এই বেলা পালা—
প্রথম দূত: হ্যাঁ, ঐ যে অস্তর দেখছ ওর একটি ঘা খেলেই সদ্য কেষ্ট প্রাপ্তি হবে।
বিভীষণ: তুই কে রে ব্যাটা মর্তে এসেছিস?
যম: কালরূপী মৃত্যু আমি যম নাম ধরি—
সর্বগ্রাসী সর্বভুক সকল সংহারি।।
সর্বকালে সমভাব সকলের প্রতি,
ত্রিভুবনে সর্বস্থানে অব্যাহত গতি।।
অন্তিমেতে দেখা দেই কৃতান্তের বেশে—
মোর সাথে পরিচয় জীবনের শেষে।।
সংসারের মহাযাত্রা ফুরায় যেমন—
শ্রান্তজনে শান্তি দেই আমিই শমন।।
[ পাহাড় লইয়া হনুমানের প্রবেশ ]
হনুমান: জয় রামের জয়!   [ যমের মাথায় পাহাড় স্থাপন। যমের পতন ]
প্রথম দূত: ও কিরে!
দ্বিতীয় দূত: ঐ যা! চাপা পড়ে গেল!
প্রথম দূত: তাই ত রে, চাপা পড়ল যে!
দ্বিতীয় দূত: (সকাতরে) হ্যাঁরে আমার মাইনে কে দেবে?
প্রথম দূত: তাই ত! আমারও যে পাওনা আছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় দূত: ওগো, আমাদের কি হল গো—ওগো, আমরা যে ধনেপ্রাণে মলুম গো—(হনুমানের প্রতি) পালোয়ান মশাই গো—সর্বনাশ কললেন গো—হায়, আমাদের কি হল গো—
প্রথম দূত: ওরে যম ব্যাটা যে দিল ফাঁকি
দ্বিতীয় দূত: মোদের তেরো আনা মাইনে বাকি
প্রথম দূত: আরে দেখনা ব্যাটা ম’ল নাকি?
দ্বিতীয় দূত: ওর চুল ধরে দে না ঝাঁকি।
প্রথম দূত: এই বিপদকালে কারে ডাকি
হায় হায় যম ব্যাটা যে দিল ফাঁকি।— অ্যাঁক্‌
[ হনুমান কর্তৃক দূতদ্বয়ের গলা পাকড়ানো ]
হনুমান: ভাগ! ভাগ!— ব্যাটারা গান ধরেছে যেন কুকুরের লড়াই বেধেছে।
[ দূতদ্বয়ের প্রস্থান ]
বিভীষণ: এবার সকলকে ডেকে নিয়ে আয়—
[ হনুমানের প্রস্থান। লক্ষ্মণকে ধরাধরি করিয়া সকলের প্রবেশ ]
সকলে: ওটা কিরে? ওটা কিরে?
হনুমান: আজ্ঞে, ওপরেরটা গন্ধমাদন পাহাড়।
জাম্বুবান: ব্যাটা গোমুখ্যু কোথাকার, পাহাড়সুদ্ধু নিয়ে এসেছিস?
হনুমান: আজ্ঞে, গাছ চিনিনে।— আর ঐ নিচেরটা যমরাজা।
সকলে: আরে, আরে করেছিস কিরে ব্যাটা? করেছিস কি?
জম্বুবান: থাক, ওমনি থাক। আগে লক্ষ্মণের একটা কিছু গতিক করে নি, তারপর দেখা যাবে—
[ ঔষধান্বেষণ—ঔষধ প্রয়োগে লক্ষ্মণের চেতনা লাভ ]
সকলে: বা, বা! কেয়াবাৎ! কেয়াবাৎ! কি সাফাই ওষুধ রে!
হনুমান: হাজার হোক— স্বদেশী ওষুধ ত!
সকলে: তাই বল! স্বদেশী না হলে কি এমন হয়?
জাম্বুবান: হ্যাঁ, এইবার যমকে ছেড়ে দাও।
[ পাহাড় সরাইয়া যমকে মুক্তিদান ]
যম: (চোখ রগ্‌ড়াইয়া লক্ষ্মণের প্রতি) সেকি! আপনি তবে বেঁচে আছেন?
লক্ষ্মণ: তা না ত কি? তুমি জ্যান্ত মানুষ নিয়ে কারবার আরম্ভ করলে কবে থেকে?
যম: আজ্ঞে, চিত্রগুপ্ত ব্যাটা আমায় ভুল বুঝিয়ে দিয়েছিল। আমি এখনি গিয়ে ব্যাটার চাকরি ঘুচোচ্ছি—
লক্ষ্মণ: হনুমান ব্যাটা বুঝি ওকে চাপা দিয়েছিল— ব্যাটার বুদ্ধি দেখ।
হনুমান: তা বুদ্ধি থাকুক আর নাই থাকুক— ওষুধ এনে বাহাদুরিটা নিয়েছি ত।
বিভীষণ: আমি পাহারা না দিলে ওষুধ কি হত রে— ওষুধ আনতে আনতে যমের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যেত। আমারই ত বাহাদুরি।
সুগ্রীব: অর্থাৎ কিনা আমার বাহাদুরি— আমি বললুম তবে ত বিভীষণ পাহারা দিল— আর বিভীষণ পাহারা দিল বলেই ত যমদূতগুলো আট্‌কা পড়ল।
জাম্বুবান: আরে ব্যাটা ওষুধের ব্যবস্থা করল কে? তোদের বুদ্ধি সে সময় উড়ে গেছিল কোথায়?
রাম: হ্যাঁ, সেটা ঠিক— কিন্তু আমি যুক্তির কথা না জিজ্ঞেস করলে তুমি হয়ত এখনো পড়ে নাক ডাকাতে!
লক্ষ্মণ: আর আমি যদি শক্তিশেল খেয়ে না পড়তাম ত এত সব কাণ্ডকারখানা কিছুই হত না— আর তোমরাও বিদ্যে জাহির করতে পারতে না।
জাম্বুবান: যাক, এখন মেলা রাত হয়ে গেছে, তোমরা স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তনপূর্বক নিদ্রার চেষ্টা দেখ; তোমাদের মাথা ঠাণ্ডা হবে আর আমিও একটু ঘুমিয়ে বাঁচব।
হনুমান: আমায় কিছু বকশিশ দেবে না?
বিভীষণ: হ্যাঁ, ওকে চারটি বাতাসা দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ করে দাও।
প্রথম: আমার কথাটি ফুরোলো
দ্বিতীয়: নটে গাছটি মুড়োলো।
তৃতীয়: ক্যান্‌রে নটে মুড়োলি
চতুর্থ: বেশ করেছি— তোর তাতে কিরে ব্যাটা।
সকলে: ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
[ ইতি সমাপ্তোয়ং লক্ষ্মণের শক্তিশেলাভিধেয়স্য কাব্যস্য চতুর্থ সর্গঃ]
0 Shares