মণিমণ্ডন

প্রসিদ্ধ মণিকার রসময় সরকারের বাড়ি হইতে একটি বহুমূল্য জড়োয়ার নেকলেস চুরি গিয়াছে। সকালবেলা খবরের কাগজ পড়িবার সময় বিলম্বিত সংবাদের স্তম্ভে খবরটা দেখিয়াছিলাম। বেলা আন্দাজ আটটার সময় টেলিফোন আসিল।

অপরিচিত ব্যগ্র কণ্ঠস্বর‌, ‘হ্যালো। ব্যোমকেশবাবু?’

বলিলাম‌, ‘না‌, আমি অজিত। আপনি কে?’

টেলিফোন বলিল‌, ‘আমার নাম রসময় সরকার। ব্যোমকেশবাবুকে একবার ডেকে দেবেন?’

নাম শুনিয়া বুঝিতে বাকি রহিল না যে‌, চোর ধরিবার জন্য ব্যোমকেশের ডাক আসিয়াছে। বলিলাম‌, ‘সে বাথরুমে গিয়েছে‌, বেরুতে দেরি হবে। কাগজে দেখলাম। আপনার দোকান থেকে নেকলেস চুরি গেছে।’

উত্তর হইল‌, ‘দোকান থেকে নয়‌, বাড়ি থেকে।–আপনি অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়‌, ব্যোমকেশবাবুর বন্ধু?’

বলিলাম‌, হ্যাঁ। ব্যোমকেশকে যা বলতে চান‌, আমাকে বলতে পারেন।’

ক্ষণেক নীরব থাকিয়া রসময় বলিলেন‌, ‘দেখুন‌, যে নেকলেসটা চুরি গেছে‌, তার দাম সাতান্ন হাজার টাকা। সন্দেহ হচ্ছে বাড়ির একটা চাকর চুরি করেছে‌, কিন্তু কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিসে অবশ্য খবর দিয়েছি‌, কিন্তু আমি ব্যোমকেশবাবুকে চাই। তিনি ছাড়া নেকলেস কেউ উদ্ধার করতে পারবে না।’

বলিলাম‌, ‘বেশ তো‌, আপনি আসুন না। আপনি আসতে আসতে ব্যোমকেশও বাথরুম থেকে বেরুবে।’

রসময় একটু কাতরভাবে বলিলেন, ‘দেখুন, আমি বেতো রুগী, বেশি নড়াচড়া করতে পারি না। তার চেয়ে যদি আপনারা আসেন তো বড় ভাল হয়।’

যাহারা বিপদে পড়ে তাহারাই ব্যোমকেশের কাছে আসে‌, সে আগে কাহারও কাছে যায় না। আমি বলিলাম‌, ‘বেশ‌, ব্যোমকেশকে বলব।’

রসময়ের মিনতি আরও নির্বন্ধপূর্ণ হইয়া উঠিল‌, ‘না না‌, বলাবলি নয়‌, নিশ্চয় আসবেন। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি‌, আপনাদের কোনও অসুবিধা হবে না।’

‘বেশ।’

‘ধন্যবাদ‌, ধন্যবাদ। এখনি গাড়ি পাঠাচ্ছি।’

মিনিট কয়েক পর একটি ক্যাডিলাক গাড়ি আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ বাথরুম হইতে বাহির হইলে সকল কথা বলিলাম এবং জানোলা দিয়া গাড়ি দেখাইলাম। দেখিয়া শুনিয়া সে আপত্তি করিল না। আমরা ক্যাডিলাকে চড়িয়া যাত্ৰা করিলাম।

কলিকাতা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে রসময় সরকারের গোটা পাঁচেক সোনাদোনা হীরা-জহরতের দোকান আছে‌, কিন্তু তাঁর বসতবাড়ি বৌবাজারে। অল্পকাল মধ্যে গাড়ি তাঁহার দ্বারে গিয়া দাঁড়াইল।

রসময় সরকারের বাড়িটি সাবেক ধরনের‌, একেবারে ফুটপাথের কিনারা হইতে তিনতলা উঠিয়া গিয়াছে। মাঝখানে উপরিতলায় উঠিবার দ্বারমুক্ত সিঁড়ি‌, দুই পাশে দোকানের সারি। গৃহস্বামী উপরের দুইতলা লইয়া থাকেন।

সিঁড়ির দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল‌, গাড়ি গিয়া থামিতেই দ্বার খুলিয়া একটি যুবক বাহির হইয়া আসিল। শৌখিন সুদৰ্শন চেহারা‌, বয়স সাতাশ আটাশ! নমস্কার করিয়া বলিল‌, ‘আমার নাম মণিময় সরকার। বাবা ওপরে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আসুন।’ .

আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে লাগিলাম। দ্বিতলে আছে রান্নাঘর‌, ভাঁড়ার ঘর‌, চাকরদের থাকিবার স্থান এবং তক্তপোশাপাতা একটি বসিবার ঘর। আমরা দ্বিতল ছাড়াইয়া ত্রিতলে উঠিয়া গেলাম। এই ত্রিতলে গৃহস্বামী সপরিবারে বাস করেন।

তৃতীয় তলে উঠিলে গৃহস্বামীর বিত্তবত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। বিলাতি তালা লাগানো ভারী দরজায় রেশমী পর্দা, মেঝেয় পুরু গালিচা; ড্রইংরুমটি দামী আসবাব দিয়া সাজানো, গদি-মোড়া দেয়ালে পারসিক ছবি-আঁকা ট্যাপেস্ট্রি ইত্যাদি। উপস্থিত ঘরটি একটু অবিন্যস্ত। মণিময় আমাদের ঘরে লইয়া গিয়া বলিল‌, ‘বাবা‌, ব্যোমকেশবাবু এসেছেন।’

দেখিলাম রসময় সরকার একটি চেয়ারে বসিয়া ডান পা সম্মুখদিকে প্রসারিত করিয়া দিয়াছেন এবং একটি বিবাহিতা যুবতী তাঁহার পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার আঙ্গুলে সেঁক দিতেছে। রসময়বাবুর বয়স অনুমান পঞ্চাশ‌, ভারী গড়নের শরীর‌, মাংসল মুখ এখনও বেশ দৃঢ় আছে। আমাদের দেখিয়া তিনি তাড়াতাড়ি উঠবার চেষ্টা করিয়া আবার বসিয়া পড়িলেন‌, আমার ও ব্যোমকেশের পানে পর্যায়ক্রমে চক্ষু ফিরাইয়া দুই করতল যুক্ত করিয়া ব্যোমকেশকে বলিলেন‌, ‘আসুন ব্যোমকেশবাবু। আমি সব দিক দিয়েই বড় কাবু হয়ে পড়েছি। আপনি-আপনারা এসেছেন‌, আমি বাঁচলাম। বসুন‌, বসুন অজিতবাবু।’

আমাদের মধ্যে কে ব্যোমকেশ তাহা প্রশ্ন না করিয়াও তিনি বুঝিয়াছেন। রসময় সরকার বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি তাহাতে সন্দেহ নাই।

আমরা সোফায় পাশাপাশি বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পায়ে বাত ধরেছে দেখছি। বাত রোগটা মারাত্মক নয়‌, কিন্তু বড় কষ্টদায়ক।’

রসময় বলিলেন‌, ‘আর বলবেন না। আমার শরীর বেশ ভালই‌, কিন্তু এই বাতে আমাকে পঙ্গু করে ফেলেছে। ছেলেবেলায় ফুটবল খেলতাম‌, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা ভেঙে গিয়েছিল। এখন এমন দাঁড়িয়েছে‌, আকাশের এক কোণে রুমালের মত একটি টুকরো মেঘ উঠলে বুড়ো আঙুলে চিড়িক মারতে থাকে।–কিন্তু সে যাক‌, বৌমা এঁদের জন্যে চা নিয়ে এস।’

বধূটি এতক্ষণ হেঁট মুখে বসিয়া শ্বশুরের পায়ে সেঁক দিতেছিল। সুন্দরী মেয়ে‌, কিন্তু তাঁহার মুখে পারিবারিক বিপদের ছায়া পড়িয়াছে। সে উঠিবার উপক্রম করিতেই ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না না‌, চায়ের দরকার নেই‌, আমি চা খেয়ে বেরিয়েছি। উনি শ্বশুরের পদসেবা করছেন করুন।’

রসময় একটু হাসিলেন‌, বধূ আবার বসিয়া পড়িল। রসময় বলিলেন‌, ‘আচ্ছা‌, তবে থাক। মণি‌, সিগারেট নিয়ে এস।’

মণিময় এতক্ষণ একটা চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া ছিল‌, সে চলিয়া গেলে রসময় বধূর পানে সস্নেহ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন‌, ‘বড় লক্ষ্মী বৌমা আমার। গিন্নী ছোট ছেলেকে নিয়ে তীর্থদর্শনে বেরিয়েছেন‌, এখন ওর হাতেই সংসার। অবশ্য ওকে দিয়ে পদেসেবা আমি করাই না‌, কিন্তু চাকরটা–’

0 Shares