১
স্বাধীনতা লাভের পর পনেরো বছর অতীত হইয়াছে। সনাতন ভারতীয় আইন অনুসারে আমাদের স্বাধীনতা দেবী সাবালিকা হইয়াছেন, পলায়নী মনোবৃত্তি ত্যাগ করিয়া কঠিন সত্যের সম্মুখীন হওয়ার সময় উপস্থিত। সুতরাং এ কাহিনী বলা যাইতে পারে।
নেংটি দত্ত নামধারী অকালপক্ক বালককে লইয়া কাহিনী আরম্ভ করিতেছি, কারণ সে না থাকিলে এই ব্যাপারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘটিত না। নেংটি একরকম জোর করিয়াই আমাদের বাসায় আসিয়া ব্যোমকেশের সহিত আলাপ জমাইয়াছিল। অত্যন্ত সংপ্রতিভ ছেলে, নাকে-মুখে কথা, বয়স সতেরো কি আঠারো, কিন্তু চেহারা রোগা-পাটকা বলিয়া আরো কম বয়স মনে হইত। এই বয়সে সে যথেষ্ট বুদ্ধি সংগ্রহ করিয়াছিল, অথচ সেই সঙ্গে একটু ন্যাকা-বোকাও ছিল; একাধারে ছেলেমানুষ এবং এঁচড়ে-পাকা। অল্প পরিচয়ে অত্যন্ত ফাজিল ও ডেপো মনে হইলেও আসলে সে যে মন্দ ছিল না। তাহার পরিচয় আমরা পাইয়াছিলাম। ব্যোমকেশকে সে মনে মনে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করিত, কিন্তু তাহার কথা শুনিয়া মনে হইত। ব্যোমকেশের সমস্ত চালাকি সে ধরিয়া ফেলিয়াছে, ব্যোমকেশের চেয়ে তাহার বুদ্ধি অনেক বেশি।
যখনই সে আমাদের বাসায় আসিত, ব্যোমকেশের সঙ্গে অপরাধ-বিজ্ঞান লইয়া পরম বিজ্ঞের মত আলোচনা করিত। ছেলেটা লেখাপড়ায় বহুদিন ইস্তফা দিয়াছে কিন্তু একেবারে অজ্ঞ নয়, ব্যোমকেশ হাসি মুখে তাহাকে আস্কারা দিত। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও দু’জনের মধ্যে প্রীতি-কৌতুক মিশ্রিত একটা সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছিল।
দুচার দিন আনাগোনা করার পর নেংটি হঠাৎ একদিন হাত বাড়াইয়া বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু্, একটা সিগারেট দিন না।’
ব্যোমকেশ বিস্ফারিত চক্ষে চাহিল, তারপর ধমক দিয়া বলিল, ‘এতটুকু ছেলে, তুমি সিগারেট খাও।‘
নেংটি বলিল, ‘পাব কোথায় যে খাব? মাসিমা একটি পয়সা উপুড়-হস্ত করে না, মাঝে-মধ্যে মেসোমশাইয়ের টিন থেকে দুএকটা চুরি করে খাই। তাছাড়া বাড়িতে কি সিগারেট খাওয়ার জো আছে? ধোঁয়ার গন্ধ পেলেই মাসিমা মারমার করে তেড়ে আসে। দিন না একটা।’
ব্যোমকেশ তাহাকে একটা সিগারেট দিল, সে তাহা পরম যত্নে সেবন করিয়া শীঘ্র আবার আসিবার আশ্বাস দিয়া প্রস্থান করিল।
অতঃপর সে যখনই আসিত তাহাকে একটা সিগারেট দিতে হইত।
একদিন নেংটি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে আসিয়া বলিল, ‘জানেন ব্যোমকেশদা, আমাদের বাড়িতে একটা মেয়ে এসেছে, ঠিক বিলিতি মেমের মত দেখতে।’
ব্যোমকেশ কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া বলিল, ‘তাই নাকি।’
নেংটি বলিল, ‘হ্যাঁ, এত সুন্দর মেয়ে আমি আর কখনো দেখিনি। আপনি যদি দেখেন ট্যারা হয়ে যাবেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে দেখব না। কে তিনি?’
নেংটি বলিল, ‘মেসোমশাইয়ের বন্ধুর মেয়ে। পূর্ববঙ্গে থাকত, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় বাপ-মা মরে গেছে; মেয়েটা কোন মতে প্ৰাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। মেসোমশাই তাকে আশ্রয় দিয়েছেন, বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। আমারই মত অবস্থা।’
মনে মনে নেংটির মেসোমশাই সন্তোষ সমাদ্দারকে সাধুবাদ করিলাম। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকিলেও নেংটির মারফৎ তাঁহার কথা জানিতাম। তিনি খ্যাতিমান ব্যক্তি, তাঁহার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কীর্তিকলাপ বাংলাদেশে কাহারও অবিদিত নয়। আমরা তাঁহার পারিবারিক পরিস্থিতির কথাও জানিতাম। বস্তুত, যে কাহিনী লিখিতেছি তাহা সন্তোষবাবুরই পারিবারিক ঘটনা।
ঘটনার পূর্বকালে ও উত্তরকালে এই পরিবারের মানুষগুলি সম্বন্ধে যাহা জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহা স্থূলভাবে এখানে লিপিবদ্ধ করিতেছি। আকস্মিক মৃত্যু আসিয়া এই সমৃদ্ধ পরিবারের সহিত আমাদের সংযোগ ঘটাইয়াছিল। আবার আকস্মিক মৃত্যুই নাটকের শেষ অঙ্কে যবনিকা টানিয়া দিয়াছিল। অনেক দিন নেংটিকে দেখি নাই–। কিন্তু যাক।
সন্তোষ সমাদ্দার ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। চৌরঙ্গী হইতে দক্ষিণ দিকে কিছুদূর যাইলে একটি উপ-রাস্তার উপর তাঁহার প্রকাণ্ড দ্বিতল বাগান-ঘেরা বাড়ি। সন্তোষবাবু কিন্তু বাড়িতে কমই থাকিতেন; সারা দিন ব্যবসা-ঘটিত কাজে-কর্মে এবং রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে কাটাইয়া সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিতেন। তাও শনিবার সন্ধ্যার পর তাঁহাকে বাড়ি পাওয়া যাইত না, অফিসের কাজ-কর্ম সারিয়া তিনি এক কীর্তন-গায়িকার গৃহে গান শুনিতে যাইতেন; তারপর একেবারে সোমবার সকালে সেখান হইতে অফিসে যাইতেন। তখন তাঁহার বয়স ছিল আন্দাজ আটচল্লিশ বছর।
তাঁর স্ত্রী চামেলি সমাদ্দার বয়সে তাঁর চেয়ে দুতিন বছরের ছোট। শীর্ণ লম্বা স্নায়ুবিক প্রকৃতির স্ত্রীলোক, যৌবনকালে সন্ত্রাসবাদীদের সহিত যুক্ত ছিলেন। সন্তোষবাবুর সহিত বিবাহের পর কয়েক বছর শান্তভাবে সংসারধর্ম পালন করিয়া ছিলেন, দু’টি যমজ পুত্রসন্তানও জন্সিয়াছিল। ক্রমে তাঁহার চরিত্রে শুচিবাই দেখা দিল, স্বভাব তীক্ষ্ণ ও ছিদ্রান্বেষী হইয়া উঠিল। বাড়িতে মাছ-মাংস রহিত হইল, স্বামীর সহিত এক বাড়িতে থাকা ছাড়া আর অন্য কোন সম্পর্ক রহিল না। এইভাবে গত দশ-বারো বছর কাটিয়াছে।
ইঁহাদের দুই যমজ পুত্র যুগলচাঁদ ও উদয়চাঁদ। বয়স কুড়ি বছর, দু’জনেই কলেজে পড়ে। যমজ হইলেও দুই ভাইয়ের চেহারা ও চরিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত; যুগলচাঁদের ছিপছিপে চেহারা, তরতরে মুখ; উদয়চাঁদ একটু গ্যাঁটা-গোটা ষণ্ডা-গুণ্ডা ধরনের। যুগলচাঁদ ঠাণ্ডা মেজাজের ছেলে; লেখাপড়ায় ভাল, লুকাইয়া কবিতা লেখে। উদয় দাম্ভিক ও দুদন্তি, সকলের সঙ্গে ঝগড়া করে, মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হোটেলে গিয়া মুর্গী খায়। শ্ৰীমতী চামেলি তাহাকে শাসন করিতে পারেন না, কিন্তু মনে মনে বোধহয় দুই ছেলের মধ্যে তাঁহাকেই একটু বেশি ভালবাসেন।