অগ্নিবাণ

খবরের কাগজখানা হতাশ হস্ত-সঞ্চালনে আমার কোলের উপর ফেলিয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘নাঃ–কোথাও কিছু নেই‌, একেবারে ফাঁক। এর চেয়ে কাগজওয়ালারা সাদা কাগজ বের করলেই পারে। তাতে ছাপার খরচটা অন্তত বেঁচে যায়।’

আমি খোঁচা দিয়া বলিলাম‌, ‘বিজ্ঞাপনেও কিছু পেলে না? বল কি? তোমার মতে তো দুনিয়ার যত কিছু খবর সব ঐ বিজ্ঞাপন-স্তম্ভের মধ্যেই ঠাসা আছে।’

বিমর্ষ মুখে চুরুট ধরাইয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না‌, বিজ্ঞাপনেও কিছু নেই। একটা লোক বিধবা বিয়ে করতে চায় বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। কুমারী ছেড়ে বিধবা বিয়ে করবার জন্যেই গোঁ ধরেছে। কেন‌, ঠিক বোঝা গেল না। নিশ্চয় কোনও বদ মতলব আছে।’

‘তা তো বটেই। আর কিছু?’

‘আর একটা বীমা কোম্পানি মহা ঘটা করে বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে‌, তারা স্বামী-স্ত্রীর জীবন একসঙ্গে বীমা করবে‌, এবং জোড়ার মধ্যে একটাকে কোনও রকমে পটল তোলাতে পারলেই অন্য জন টাকা পাবে। এইসব বীমা কোম্পানি এমন করে তুলেছে যে‌, মরেও সুখ নেই।’

‘কেন‌, এর মধ্যেও বাদ মতলব আছে নাকি?’

‘বীমা কোম্পানির নিজের স্বাৰ্থ না থাকতে পারে‌, কিন্তু অন্যের মনে দুবুদ্ধি জাগিয়ে তোলাও সৎকার্য নয়।’

‘অর্থাৎ? মানে হল কি?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিল না‌, হৃদয়ভারাক্রান্ত একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া টেবিলের উপর পা তুলিয়া দিল‌, তারপর কড়িকাঠের দিকে অনুযোগপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাইয়া নীরবে ধূম উদগিরণ করিতে লাগিল।

শীতকাল; বড়দিনের ছুটি চলিতেছিল। কলিকাতার লোক বাহিরে গিয়া ও বাহিরের লোক কলিকাতায় আসিয়া মহা সমারোহে ছুটি উদযাপন করিতেছিল। কয়েক বছর আগেকার কথা‌, তখন ব্যোমকেশের বিবাহ হয় নাই।

আমরা দুইজনে চিরন্তন অভ্যাসমত সকালে উঠিয়া একত্র চা-পান ও সংবাদপত্রের ব্যবচ্ছেদ করিতেছিলাম। গত তিন মাস একেবারে বেকারভাবে বসিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশের ধৈর্যের লৌহ-শৃঙ্খলও বোধ করি ছিড়িবার উপক্ৰম করিয়াছিল। দিনের পর দিন সংবাদপত্রের নিম্প্রাণ ও বৈচিত্র্যহীন পৃষ্ঠা হইতে অপদাৰ্থ খবর সংগ্ৰহ করিয়া সময় আর কাটিতে চাহিতেছিল না। আমার নিজের মনের অবস্থা যেরূপ শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল‌, তাহা হইতেই বুঝিতেছিলাম‌, ব্যোমকেশের মস্তিষ্কের ক্ষুধা ইন্ধন অভাবে কিরূপ উগ্র ও দুর্বাহ হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তবু সমবেদনা প্রকাশ করিয়া তাহাকে শান্ত করিবার চেষ্টা করি নাই; বরঞ্চ এই অনীন্সিত নৈষ্কর্মের জন্য যেন সে-ই মূলতঃ দায়ী্‌্‌, এমনিভাবে তাহাকে ব্যঙ্গ-বিদ্যুপ করিয়াছি।

আজ প্রভাতে তাহার এই হতাশাপূর্ণ ভাব দেখিয়া আমার একটু অনুশোচনা হইল। মস্তিষ্কের খোরাক সহসা বন্ধ হইয়া গেলে সুস্থ বলবান মস্তিষ্কের কিরূপ দুৰ্দশা হয়‌, তাহা তো জানিই‌, উপরন্তু আবার বন্ধুর খোঁচা খাইতে হইলে ব্যাপারটা নিতান্তই নিষ্কারুশি হইয়া পড়ে।

আমি আর তাহাকে প্রশ্ন না করিয়া অনুতপ্ত চিত্তে খবরের কাগজখানা খুলিলাম।

এই সময়ে চারিদিকে সভা সমিতি ও অধিবেশনের ধুম পড়িয়া যায়‌, এবারেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। সংবাদ-ব্যবসায়ীরা সরসতর সংবাদের অভাবে এইসব সভার মামুলি বিবরণ ছাপিয়া পৃষ্ঠা পূর্ণ করিয়াছে। তাহার ফাঁকে ফাঁকে সিনেমা ও থিয়েটার-সাকাসের বিজ্ঞাপন সচিত্র ও বিচিত্ররূপে আমোদ-লোলুপ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করিতেছে।

দেখিলাম‌, কলিকাতাতেই গোটা পাঁচেক বড় বড় সভা চলিতেছে। তা ছাড়া দিল্লীতে নিখিল ভারতীয় বিজ্ঞান-সভার অধিবেশন বসিয়াছে। ভারতের নানা দিগদেশ হইতে অনেক হোমরা-চোমরা বৈজ্ঞানিক পণ্ডিত একজোট হইয়াছেন এবং বাক্যধুমে বোধ করি দিল্লীর আকাশ বিষাক্ত করিয়া তুলিয়াছেন। সংবাদপত্রের মারফত যতটুকু ধুম চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে তাহারই ঠেলায় মস্তিষ্ক কোটরে কুল পড়িবার উপক্রম হইয়াছে।

আমি সময় সময় ভাবি‌, আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিকরা কাজ না করিয়া এত বাগবিস্তার করেন কেন? দেখিতে পাই‌, যিনি যত বড় বৈজ্ঞানিক‌, তিনি তার চতুৰ্ত্তণ বাগ্মী। বেশি কিছু নয়‌, স্টীম এঞ্জিন বা এরোপ্লেনের মত একটা যন্ত্রও যদি ইহারা আবিষ্কার করিতে পারিতেন‌, তাহা হইলেও তাঁহাদের বাচালতা ধৈর্য ধরিয়া শুনিতাম। কিন্তু ও সব দূরে থাক‌, মশা মারিবার একটা বিষও তাঁহারা আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। বুজরুকি আর কাহাকে বলে!

নিরুৎসুকিভাবে বিজ্ঞান-কংগ্রেসের বিবরণ পড়িতে পড়িতে একটা নাম দৃষ্টি আকর্ষণ করিলইনি কলিকাতার একজন খ্যাতনামা প্রফেসর ও বিজ্ঞান-গবেষক-নাম দেবকুমার সরকার। বিজ্ঞান-সভায় ইনি সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়াছেন। অবশ্য ইনি ছাড়া অন্য কোনও বাঙালী যে বক্তৃতা দেন নাই‌, এমন নয়‌, অনেকেই দিয়াছেন; কিন্তু বিশেষ করিয়া দেবকুমারবাবুর নামটা চোখে পড়িবার কারণ, কলিকাতায় তিনি আমাদের প্রতিবেশী, আমাদের বাসার কয়েকখানা বাড়ির পরে গলির মুখে তাঁহার বাসা। তাঁহার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ আলাপ ছিল না‌, কিন্তু তাঁহার পুত্ৰ হাবুলের সম্পর্কে আমরা তাঁহার সহিত নেপথ্য হইতেই ঘনিষ্ঠ হইয়া পড়িয়ছিলাম।

দেবকুমারবাবুর ছেলে হাবুল কিছুদিন হইতে ব্যোমকেশের ভক্ত হইয়া পড়িয়ছিল। ছোকরার বয়স আঠারো-উনিশ‌, কলেজের দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে পড়িত। ভালমানুষ ছেলে‌, আমাদের সম্মুখে বেশি কথা বলিতে পারিত না‌, তদগতভাবে ব্যোমকেশের মুখের পানে চাহিয়া থাকিত। ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া এই অস্ফুটবাক ভক্তের পূজা গ্ৰহণ করিত; কখনও চা খাইবার নিমন্ত্ৰণ করিত। হাবুল একেবারে কৃতাৰ্থ হইয়া যাইত।

0 Shares