হেঁয়ালির ছন্দ

ব্যোমকেশ সরকারী কাজে কটকে গিয়াছিল‌, আমিও সঙ্গে ছিলাম। দুচার দিন সেখানে কাটাইবার পর দেখা গেল‌, এ দু’চার দিনের কাজ নয়‌, সরকারী দপ্তরের পর্বতপ্রমাণ দলিল দস্তাবেজ ঘাঁটিয়া সত্য উদঘাটন করিতে সময় লাগিবে। তখন ব্যোমকেশ কটকে থাকিয়া গেল‌, আমি কলিকাতায় সুপ্রিয়া আসিলাম। বাড়িতে একজন পুরুষ না থাকিলে বাঙালী গৃহস্থের সংসার চলে কি করিয়া?

কলিকাতায় আসিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছি। ব্যোমকেশ নাই‌, নিজেকে একটু অসহায় মনে হইতেছে। শীত পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে‌, বেলা ছোট হইতেছে; তবু সময় কাটিতে চায় না। মাঝে মাঝে দোকানে যাই‌, প্রভাতের কাজকর্ম দেখি‌, নূতন পাণ্ডুলিপি আসিলে পড়ি। কিন্তু তবু দিনের অনেকখানি সময় শূন্য পড়িয়া থাকে।

তারপর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যা কাটাইবার একটা সুযোগ জুটিয়া গেল।

আমাদের বাসাবাড়িটা তিনতলা। উপরতলায় গোটা পাঁচেক ঘর লইয়া আমরা থাকি‌, মাঝের তলার ঘরগুলিতে দশ-বারো জন চাকুরে ভদ্রলোক মেস করিয়া আছেন। নীচের তলায় ম্যানেজারের অফিস‌, ভাঁড়ার ঘর‌, রান্নাঘর‌, খাওয়ার ঘর‌, কেবল কোণের একটি ঘরে এক ভদ্রলোক থাকেন। এঁদের সকলের সঙ্গেই আমাদের মুখ চেনাচিনি আছে‌, কিন্তু বিশেষ ঘনিষ্ঠতা নাই।

সেদিন সন্ধ্যার পর আলো জ্বালিয়া একটা মাসিকপত্র লইয়া বসিয়াছি‌, দ্বারে টোকা পড়িল। দ্বার খুলিয়া দেখিলাম‌, একটি মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বিনীত হাস্যমুখে দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহাকে আগে দু’একবার বাসাবাড়ির দ্বিতলে দেখিয়াছি‌, কিছুদিন হইল মেসে বাসা লইয়াছেন। দ্বিতলের এক কোণে সেরা ঘরটি ভাড়া লইয়া একাকী বাস করিতেছেন। একটু শৌখিন গোছের লোক‌, সিল্কের চুড়িদার পাঞ্জাবির উপর গরম জবাহর-কুর্তা‌, মাথার চুল পাকার চেয়ে কাঁচাই বেশি। ফিট্‌ফট চেহারা।

যুক্ত করে নমস্কার করিয়া বলিলেন ‘মাপ করবেন‌, আমার নাম ভূপেশ চট্টোপাধ্যায়‌, দোতলায় থাকি।’

বলিলাম‌, আপনাকে কয়েকবার দেখেছি। নাম জানতাম না। আসুন।’

ঘরে আনিয়া বসাইলাম। তিনি বলিলেন‌, ‘মাস দেড়েক হল কলকাতায় এসেছি‌, বীমা কোম্পানিতে কাজ করি‌, কখন কোথায় আছি কিছু ঠিক নেই। হয়তো কালই অন্য কোথাও বদলি করে দেবে।’

আমি একটু অস্বস্তি বোধ করিয়া বলিলাম‌, আপনি বীমা কোম্পানির লোক! কিন্তু আমি তো কখনো জীবনবীমা করাইনি‌, কারাবার পরিকল্পনাও নেই।’

তিনি হাসিয়া বলিলেন‌, ‘না না‌, আমি সেজন্যে আসিনি। আমি বীমা কোম্পানির অফিসে কাজ করি বটে‌, কিন্তু দালাল নই। আমি এসেছিলাম—? একটু অপ্রস্তুতভাবে থামিয়া বলিলেন‌, ‘আমার ব্রিজ খেলার নেশা আছে। এখানে এসে অবধি খেলতে পাইনি‌, পেট ফুলছে। অতি কষ্টে দু’টি ভদ্রলোককে যোগাড় করেছি। তাঁরা দোতলায় তিন নম্বর ঘরে থাকেন। কিন্তু চতুর্থ ব্যক্তিকে পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকদিন কটগ্রেট ব্রিজ খেলে কাটালাম‌, কিন্তু দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে। আজ ভাবলাম দেখি যদি অজিতবাবুর ব্রিজ খেলার শখ থাকে।’

এক সময় ব্রিজ খেলার শখ ছিল। শখ নয়‌, প্রচণ্ড নেশা। অনেকদিন খেলি নাই‌, নেশা মরিয়া গিয়াছে। তবু মনে হইল সঙ্গিহীনভাবে নীরস পত্রিকা পড়িয়া সন্ধ্যা কাটানোর চেয়ে বরং ব্রিজ ভাল।

বলিলাম‌, ‘বেশ তো‌, বেশ তো। আমার অবশ্য অভ্যোস ছেড়ে গেছে‌, তবু— মন্দ কি।’

সময় নষ্ট করে লাভ নেই।’

বলিলাম‌, ‘আপনি এগোন‌, আমি চা খেয়েই যাচ্ছি।’

তিনি বলিলেন‌, ‘না না‌, আমার ঘরেই চা খাবেন। —চলুন।’

তাঁহার আগ্রহ দেখিয়া হাসি পাইল। এক কালে আমারও এমনি আগ্রহ ছিল‌, সন্ধ্যার সময় ব্রিজ না খেলিলে মনে হইত দিনটা বৃথা গেল।

উঠিয়া পড়িলাম। সত্যবতীকে জানাইয়া ভূপেশবাবুর সঙ্গে নীচে নামিয়া চলিলাম।

সিঁড়ি দিয়া নামিয়া দ্বিতলের প্রথম ঘরটি ভূপেশবাবুর। নিজের দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া তিনি হাঁক দিলেন‌, ‘রামবাবু্‌, বনমালীবাবু্‌, আপনারা আসুন। অজিতবাবুকে পাকড়েছি।’

বারান্দার মধ্যস্থিত তিন নম্বর ঘরের দ্বার হইতে দু’টি মুণ্ড উঁকি মারিল‌, তারপর ‘আসছি বলিয়া শঙ্কয়া গেল। ভূপেশবাবু আমাকে ইয়া নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন এবং আলো জ্বলিয়া ভূপেশবাবুর ঘরটি বেশ সুপরিসর। বাহিরের দিকের দুই দেয়ালে দু’টি গরাদযুক্ত জানালা। ঘরের এক পাশে তক্তপোশের উপর সুজুনি-ঢাকা বিছানা‌, অন্য পাশে খালি আলমারির মাথায় ঝকঝকে স্টোভ‌, চায়ের সরঞ্জাম ইত্যাদি। ঘরের মাঝখানে একটি নীচু টেবিল ঘিরিয়া চারখানি চেয়ার‌, স্পষ্টই বোঝা যায় তাস খেলিবার টেবিল। তা ছাড়া ঘরে ড্রেসিং টেবিল‌, কাপড় রাখার দেরাজ প্রভৃতি যে-কয়টি ছোটখাটো আসবাব আছে সমস্তাই সুরুচির পরিচায়ক। ভূপেশবাবুর রুচি একটু বিলাত-ঘেঁষা।

ভূপেশবাবু আমাকে চেয়ারে বসাইয়া বলিলেন, চায়ের জলটা চড়িয়ে দিই, পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে যাবে।

তিনি স্টেভ জ্বলিয়া জল চড়াইলেন। ইতিমধ্যে রামবাবু ও বনমালীবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

পূর্বে পরিচয় থাকিলেও ভূপেশবাবু আর একবার পরিচয় করাইয়া দিলেন, ইনি রামচন্দ্র রায়, আর ইনি বনমালী চন্দ। দু’জনে একই ঘরে থাকেন এবং একই ব্যাঙ্কে কাজ করেন।’

আমি লক্ষ্য করিলাম‌, আরো ঐক্য আছে; একসঙ্গে দু’জনকে কখনো দেখি নাই বলিয়াই বোধ হয় লক্ষ্য করি নাই। দু’জনেরই বয়স পঁয়তাল্লিশ হইতে পঞ্চাশের মধ্যে‌, দু’জনেরই মোটাসোটা মাঝারি দৈর্ঘ্যের চেহারা‌, দু’জনেরই মুখের ছাঁচ একরকম; মোটা নাক‌, বিরল ভুরু‌, চওড়া চিবুক। সাদৃশ্যটা স্পষ্টই বংশগত। আমার লোভ হইল ইহাদের চমক লোগাইয়া দিই। হাজার হোক‌, আমি ব্যোমকেশের বন্ধু।

0 Shares