মাকড়সার রস

ব্যোমকেশকে এক রকম জোর করিয়াই বাড়ি হইতে বাহির করিয়াছিলাম।

গত একমাস ধরিয়া সে একটা জটিল জালিয়াতের তদন্তে মনোনিবেশ করিয়াছিল, একগাদা দলিল পত্র লইয়া রাতদিন তাহার ভিতর হইতে অপরাধীর অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিল এবং রহস্য যতই ঘনীভূত হইতেছিল ততই তাহার কথাবার্তা কমিয়া আসিতেছিল। লাইব্রেরী ঘরে বসিয়া নিরন্তর এই শুষ্ক কাগজপত্রগুলো ঘাঁটিয়া তাহার শরীরও খারাপ হইয়া পড়িতেছে দেখিতেছিলাম, কিন্তু সে-কথার উল্লেখ করিলে সে বলিত,–“নাঃ, বেশ তো আছি–”

সেদিন বৈকালে বলিলাম–“আর তোমার কথা শোনা হবে না, চল একটু বেড়িয়ে আসা যাক। দিনের মধ্যে অন্তত দু’ঘণ্টাও তো বিশ্রাম দরকার।”

“কিন্তু–”

“কিন্তু নয়–চল লেকের দিকে। দু’ঘণ্টায় তোমার জালিয়াৎ পালিয়ে যাবে না।”

“চল–” কাগজপত্র সরাইয়া রাখিয়া সে বাহির হইলে বটে কিন্তু তাহার মনটা সেই অজ্ঞাত জালিয়াতের পিছু ছাড়ে নাই বুঝিতে কষ্ট হইল না।

লেকের ধারে বেড়াইতে বেড়াইতে হঠাৎ একজন বহু পুরাতন কলেজের বন্ধুর সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। অনেকদিন তাহাকে দেখি নাই; আই. এ. ক্লাশে দু’জনে একসঙ্গে পড়িয়াছিলাম, তারপর সে মেডিকেল কলেজে প্রবেশ করে। সেই অবধি ছাড়াছাড়ি। আমি তাহাকে দেখিয়া বলিলাম–“আরে! মোহন যে! তুমি কোত্থেকে?”

সে আমাকে দেখিয়া সহর্ষে বলিল–“অজিত! তাই তো হে! কদ্দিন পরে দেখা! তারপর খবর কি?”

কিছুক্ষণ পরস্পরের পিঠ চাপড়া-চাপড়ির পর ব্যোমকেশের সহিত পরিচয় করিয়া দিলাম। মোহন বলিল–“আপনিই? বড় খুশি হলুম। মাঝে মাঝে সন্দেহ হত বটে, আপনার কীর্তি-প্রচারক অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো আমাদের বাল্যবন্ধু অজিত; কিন্তু বিশ্বাস হত না।”

জিজ্ঞাসা করিলাম–“তুমি আজকাল কি করছ?”

মোহন বলিল–“কলকাতাতেই প্রাক্‌টিস করছি।”

তারপর বেড়াইতে বেড়াইতে নানা কথায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়া গেল। লক্ষ্য করিলাম, সাধারণ কথাবার্তার মধ্যে মোহন দু’ একবার কি একটা বলিবার জন্য মুখ খুলিয়া আবার থামিয়া গেল। ব্যোমকেশও তাহা লক্ষ্য করিয়াছিল, তাই এক সময় অল্প হাসিয়া বলিল–“কি বলবেন বলুন না।”

মোহন একটু লজ্জিত হইয়া বলিল–“একটা কথা বলি-বলি করেও বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে। ব্যাপারটা এত তুচ্ছ যে সে নিয়ে আপনাকে বিব্রত করা অন্যায়। অথচ–”

আমি বলিলাম–“তা হোক, বল। আর কিছু না হোক, ব্যোমকেশকে কিছুক্ষণের জন্য জালিয়াতের হাত থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া তো হবে।”

“জালিয়াৎ?”

আমি বুঝাইয়া দিলাম। তখন মোহন বলিল–“ও! কিন্তু আমার কথা শুনে হয়তো ব্যোমকেশবাবু হাসবেন–”

ব্যোমকেশ বলিল–“হাসির কথা হলে নিশ্চয় হাসব, কিন্তু আপনার ভাব দেখে তা মনে হচ্ছে না। বরঞ্চ বোধ হচ্ছে একটা কোনও সমস্যা কিছুদিন থেকে আপনাকে ভাবিত করে রেখেছে–আপনি তারই উত্তর খুঁজছেন।”

মোহন সাগ্রহে কহিল–“আপনি ঠিক ধরেছেন। জিনিসটা হয়তো খুবই সহজ–কিন্তু আমার পক্ষে একটা দুর্ভেদ্য প্রহেলিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি নেহাত বোকা নই–সাধারণ সহজ-বুদ্ধি আছে বলেই মনে করি; অথচ একজন রোগে পঙ্গু চলৎশক্তিরহিত লোক আমাকে প্রত্যহ এমনভাবে ঠকাচ্ছে যে শুনলে আশ্চর্য হয়ে যাবেন; শুধু আমাকে নয়, তার সমস্ত পরিবারের তীক্ষ্ণ সতর্কতা সে প্রতি মুহূর্তে ব্যর্থ করে দিচ্ছে।”

কথা কহিতে কহিতে আমরা একটা বেঞ্চিতে আসিয়া বসিয়াছিলাম। মোহন বলিল–“যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলছি–শুনুন। কোনো একটা বড় মানুষের বাড়িতে আমি গৃহ-চিকিৎসক। তাঁরা বনেদী বড়মানুষ, কলকাতায় বন কেটে বাস; অন্যান্য বিষয় সম্পত্তি ছাড়াও কলকাতায় একটা বাজার আছে–তা থেকে মাসিক হাজার পনের টাকা আয়। সুতরাং আর্থিক অবস্থা কি রকম বুঝতেই পারছেন।

“এই বাড়ির যিনি কর্তা তাঁর নাম নন্দদুলালবাবু। ইনিই বলতে গেলে ও বাড়িতে আমার একমাত্র রুগী। বয়স কালে ইনি এত বেশি বদ-খেয়ালী করেছিলেন যে পঞ্চাশ বছর বয়স হতে না হতেই শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে। বাতে পঙ্গু, আরো কত রকম ব্যাধি যে তাঁর শরীরকে আশ্রয় করে আছে তা গুণে শেষ করা যায় না। তাছাড়া পক্ষাঘাতের লক্ষণও ক্রমে দেখা দিচ্ছে। আমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রে একটা কথা আছে,–মানুষের মৃত্যুতে বিস্মিত হবার কিছু নেই, মানুষে যে বেঁচে থাকে এইটেই সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়। আমার এই রুগীটিকে দেখলে সেই কথাই সর্বাগ্রে মনে পড়ে।

“এই নন্দদুলালবাবুর চরিত্র আপনাকে কি করে বোঝাব ভেবে পাচ্ছি না। কটুভাষী, সন্দিগ্ধ, কুটিল, হিংসাপরায়ণ–এক কথায় এমন ইতর নীচ স্বভাব আমি আর কখনো দেখিনি। বাড়িতে স্ত্রী পুত্র পরিবার সব আছে কিন্তু কারুর সঙ্গে সদ্ভাব নেই। তাঁর ইচ্ছা যৌবনে যে উচ্ছৃঙ্খলতা করে বেড়িয়েছেন এখনো তাই করে বেড়ান। কিন্তু প্রকৃতি বাদ সেধেছেন, শরীরে সে সামর্থ্য নেই। এই জন্য পৃথিবীসুদ্ধ লোকের ওপর দারুণ রাগ আর ঈর্ষা–যেন তাঁর এই অবস্থার জন্য তারাই দায়ী। সর্বদা ছল খুঁজে বেড়াচ্ছেন কি করে কাকে জব্দ করবেন।

“শরীরের শক্তি নেই, বুকের গোলমালও আছে–তাই ঘর ছেড়ে বেরুতে পারেন না, নিজের ঘরে বসে বসে কেবল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ওপর কদর্য গালাগাল বর্ষণ করছেন, আর দিস্তে দিস্তে কাগজে অনবরত লিখে চলেছেন। তাঁর এক খেয়াল যে তিনি একজন অদ্বিতীয় সাহিত্যিক; তাই কখনো লাল কালিতে কখনো কালো কালিতে এন্তার লিখে যাচ্ছেন। সম্পাদকের ওপর ভয়ঙ্কর রাগ, তাঁর বিশ্বাস সম্পাদকেরা কেবল শত্রুতা করেই তাঁর লেখা ছাপে না।”

0 Shares