শুভদা – প্রথম অধ্যায়

প্রথম পরিচ্ছেদ

গঙ্গায় আগ্রীব নিমজ্জিতা কৃষ্ণপ্রিয়া ঠাকুরানী চোখ কান রুদ্ধ করিয়া তিনটি ডুব দিয়া পিত্তল-কলসীতে জলপূর্ণ করিতে করিতে বলিলেন, কপাল যখন পোড়ে তখন এমনি করেই পোড়ে।

ঘাটে আরো তিন-চারিজন স্ত্রীলোক স্নান করিতেছিল, তাহারা সকলেই অবাক হইয়া ঠাকুরানীর মুখপানে চাহিয়া রহিল। পাড়াকুঁদুলি কৃষ্ণঠাকরুনকে সাহস করিয়া কোন একটা কথা জিজ্ঞাসা করা, কিংবা কোনরূপ প্রতিবাদ করা, যাহার তাহার সাহসে কুলাইত না। বিশেষতঃ যাহারা ঘাটে ছিল তাহারা সকলেই তাঁহা অপেক্ষা বয়ঃকনিষ্ঠা।

তাই বলচি বিন্দু, মানুষের কপাল যখন পোড়ে তখন এমনি করেই পোড়ে।

যে ভাগ্যবতীকে উদ্দেশ করিয়া বলা হইল তাহার নাম বিন্দুবাসিনী। বিন্দু বড়লোকের মেয়ে, বড়লোকের বৌ, সম্প্রতি বাপের বাটী আসিয়াছিল।

বিন্দু দেখিল কথাটা তাহাকেই বলা হইয়াছে, তাই সাহসে ভর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন পিসীমা?

এই হারাণ মুখুজ্যের কথাটা মনে পড়ল। ভগবান যেন ওদের মাথায় পা দিয়া ডুবুচ্চেন।

বিন্দুবাসিনী বুঝল হারাণ মুখুজ্যেদের দুরদৃষ্টের কথা হইতেছে। সেও দুঃখিতা হইল। প্রায় একমাস হইল হারাণের পাঁচ-ছয় বৎসরের একটি ছেলের মৃত্যু হইয়াছিল। সেই কথা মনে করিয়া বলিল, ভগবান কেড়ে নিলে মানুষের হাত কি? আর জন্ম-মৃত্যু কার ঘরে নেই বল!

প্রথমে কথাটার অর্থ কৃষ্ণঠাকুরানী ভাল বুঝিতে পারিলেন না। কিছুক্ষণ পরে বলিয়া উঠিলেন, আহা, মাসখানেক হল ছেলে মারা গেছে বটে! সেকথা নয় বিন্দু, সেকথা নয়; মরা-বাঁচা ভগবানের হাতই বটে, কিন্তু এটা—তুই বুঝি কিছু শুনিস নি মা?

বিন্দুবাসিনী কিছু বলিল না, কেবল তাঁহার মুখপানে চাহিয়া রহিল।

কৃষ্ণপ্রিয়া পুনশ্চ বলিলেন, হারাণ মুখুজ্যের কথা বুঝি কিছু শুনিস নি?

বিন্দু জিজ্ঞাসা করিল, তাঁর আবার কিসের কথা?

আহা! তাই ত বলছিলাম মা, ভগবান যখন মারেন তখন এমনি করেই মারেন। কিন্তু পোড়ারমুখো মিন্‌সের জন্য ত কষ্ট হয় না, কষ্ট হয় সোনার প্রতিমে বৌটার কথা মনে হলে। হতভাগী ড্যাক্‌রার হাতে পড়ে ত একদিনের তরেও সুখী হ’ল না।

বিন্দু যেমন মুখপানে চাহিয়াছিল তেমনি রহিল, বিশেষ কিছুই বুঝিতে পারিল না। কিন্তু ঠাকুরানীরও এত কথা নিরর্থক বলা হয় নাই; সেজন্য তিনি মূল কথাটা প্রচ্ছন্ন রাখিয়া ডালপালা ছড়াইতে ছিলেন তাহা সমাধা হইল। ঘাটে যতগুলি শ্রোতা ছিল কাহারও বিস্ময় ও কৌতূহলের সীমা রহিল না। প্রত্যেকেই মনে করিতে লাগিল, হারাণ মুখুজ্যের এমন কি কথা হইতে পারে যাহা তাহারা জানে না, অথচ গ্রামের সকলেই জানে।

অনেকক্ষণ ভাবিয়া চিন্তিয়া বিন্দু কহিল, পিসিমা, কথাটা কি শুনতে পাইনে?

পি। কেন পাবে না মা? কিন্তু এ ত আর সুখের কথা নয়—তাই বলতে ইচ্ছে করে না, যখনই মনে পড়ে তখনি যেন বুকের মাঝখানটা টনটন করে ওঠে। আহা, ভগবান অমন মেয়ের কপালেও এত কষ্ট লিখেছিলেন !

বি। কিসের কষ্ট?

পি। কষ্ট কি এক রকমের? কত রকমের কত কষ্ট কত যাতনা তা তোদের কি আর বলব?

বি। তবু শুনিই না পিসিমা?

পি। না এখন থাক। কিছুই চাপা থাকবে না, সকলেই শুনতে পাবে—পেয়েচেও। কিছু আগে আর কিছু পরে— তোরাও সবাই শুনতে পাবি।

বি। তুমিই বল না!

পি। না না, আর বলব না। পরের কথাতে আর থাকব না মনে করেচি।

বিন্দু হাসিয়া বলিল, পিসিমা, আমরা কি তোমার পর? আমি জানি তুমি আমাকে বলবেই।

পি। বিন্দু, গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে কি তবে মিথ্যা কথা বলব?

বি। কিসের মিথ্যে কথা? মিথ্যা কথা কি তোমাকে বলতে বলেচি?

পি। তবে কেমন করে বলা হয়? এই যে গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে বললাম, পরের কথায় আর থাকব না।

কলহপ্রিয়া কৃষ্ণঠাকুরানী চলিয়া গেলে সকলেই সকলের মুখপানে চাহিয়া রহিল। কেহ কিছুতেই বুঝিতে পারিল না, বিশেষ ঠাকুরানীকে এ পর্যন্ত কেহ কখনো কথা বলিতে গিয়া চাপিয়া যাইতে দেখে নাই। স্নান সমাপ্ত হইলে সকলেই আপন আপন বাটীতে প্রস্থান করিল।

বিন্দু বাটীতে আসিয়া কাপড় ছাড়িয়া মাতার নিকট আসিয়া বসিল।

তিনি বলিলেন, বিন্দু, এতক্ষণ ধরে কি জলে পড়ে থাকে মা, অসুখ হলে কি হবে বল দেখি?

বি। কি আর হবে,—দু’দিন ভুগব।

বিন্দুর মাতা হাসিয়া বলিলেন, সোজা কথা, এর জন্যে আর ভাবনা কি!

বিন্দু বলিল, মা, হারাণ মুখুজ্যেদের আবার কি হয়েছে?

মা। কি আবার হবে?

বি। আজ ঘাটে কৃষ্ণপিসিমার কথার ভাবে বোধ হয় তাদের নূতন কিছু একটা ঘটেচে। তুমি কিছু শোননি?

মা। কিছুই না। কি বললে?

বি। বললে যে হারাণ মুখুজ্যেদের ভগবান মাথায় পা দিয়ে ডুবুচ্চেন, কিন্তু পোড়ারমুখো মিন্‌সের জন্যে ত কষ্ট হয় না—কষ্ট হয় সোনার প্রতিমে বৌটার জন্যে। এইটুকু বলে, আর কিছু বললে না। বলে, পরের কথায় আর থাকব না।

মা। ঠাকরুনের এতদিনের পর ধর্মজ্ঞান জন্মেচে!

বি। মা, সত্যি তুমি কিছু জান না?

মা। কিছু না।

বি। তবে আজ আমি দুপুরবেলা ওদের বাড়িতে যাব।

মা। কেন? কি দুর্ঘটনা ঘটেচে জানবার জন্যে?

বি। হ্যাঁ—

মা। তুই কি পাগল হয়েছিস? যে কথায় উনি থাকতে চাইলেন না, সেকথাটা তুই জিজ্ঞাসা করতে যাবি?

বি। উনি কে?

বিন্দুর মা একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, এই কৃষ্ণঠাকরুন।

বি। কৃষ্ণঠাকরুন কি আদর্শ, যে উনি যা না করবেন তা আর কাউকে করতে নেই?

মা। এসব বিষয়ে তা একরকম আদর্শ বৈ কি।

বি। তা হোক, আমি যাব।

মা। পরের কথায় না হয় নাই থাকলে?

বি।আচ্ছা, মা, একজন যদি ডুবতে থাকে, ‘পরের কথায় কাজ নেই’ বলে তাকে আর তুলতে নেই?

মা। তুই ত আর তুলতে যাচ্ছিসনে বিন্দু?

বি। কে ডুবচে জানলে যাব বৈ কি!

বিন্দুর জননী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, বিন্দু, তোমার ওদের বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। হারাণ মুখুজ্যে লোক ভাল নয়, তোমার বাপের সঙ্গে ওর শত্রুতা আছে; তোমার কি ওদের বাড়ি যাওয়া ভাল দেখায়?

0 Shares