পথের কাঁটা

ব্যোমকেশ খবরের কাগজখানা সযত্নে পাট করিয়া টেবিলের এক পাশে রাখিয়া দিল। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়া অন্যমনস্কভাবে জানালার বাহিরে তাকাইয়া রহিল।

বাহিরে কুয়াশা-বর্জিত ফাল্গুনের আকাশে সকালবেলার আলো ঝলমল করিতেছিল। বাড়ির তেতলার ঘর কয়টি লইয়া আমাদের বাসা, বসিবার ঘরটির গবাক্ষপথে শহরের ও আকাশের একাংশ বেশ দেখা যায়। নীচে নবোদ্‌বুদ্ধ নগরীর কর্মকোলাহল আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। হ্যারিসন রোদের উপর গাড়ি-মোটর-ট্রামের ছুটাছুটি ও ব্যস্ততার অন্ত নাই। আকাশেও এই চাঞ্চল্য কিয়ৎপরিমাণে প্রতিফলিত হইয়াছে। চড়াই পাখিগুলো অনাবশ্যক কিচিমিচি করিতে করিতে আকাশে উড়িয়া বেড়াইতেছে; তাহাদের অনেক ঊর্ধ্বে একঝাঁক পায়রা কলিকাতা শহরটাকে নীচে ফেলিয়া যেন সূর্যলোক পরিভ্রমণ করিবার আশায় ঊর্ধ্ব হইতে আরো ঊর্ধ্বে উঠিতেছে।

বেলা প্রায় আটটা, প্রভাতী চা ও জলখাবার শেষ করিয়া আমরা দুইজন অলসভাবে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা হইতে বহির্জগতের বার্তা গ্রহণ করিতেছিলাম।

ব্যোমকেশ জানালার দিক্‌ হইতে চক্ষু ফিরাইয়া বলিল–“কিছুদিন থেকে কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে, লক্ষ্য করেছ?”

আমি বলিলাম–“না। বিজ্ঞাপন আমি পড়ি না।”

ভ্রু তুলিয়া একটু বিস্মিতভাবে ব্যোমকেশ বলিল–“বিজ্ঞাপন পড় না? তবে পড় কি?”

“খবরের কাগজে সবাই যা পড়ে, তাই পড়ি–খবর।”

“অর্থাৎ মাঞ্চুরিয়ার কার আঙুল কেটে গিয়ে রক্তপাত হয়েছে আর ব্রেজিলে কার একসঙ্গে তিনটে ছেলে হয়েছে, এই পড়! ওসব পড়ে লাভ কী? সত্যিকারের খাঁটি খবর যদি পেতে চাও, তাহলে বিজ্ঞাপন পড়।”

ব্যোমকেশ অদ্ভুত লোক, কিন্তু সে পরিচয় ক্রমশ প্রকাশ পাইবে। বাহির হইতে তাহাকে দেখিয়া বা তাহার কথা শুনিয়া একবারও মনে হয় না যে, তাহার মধ্যে অসামান্য কিছু আছে।

কিন্তু তাহাকে খোঁচা দিয়া, প্রতিবাদ করিয়া, একটু উত্তেজিত করিয়া দিতে পারিলে ভিতরকার মানুষটি কচ্ছপের মত বাহির হইয়া আসে। সে স্বভাবত স্বল্পভাষী, কিন্তু ব্যঙ্গবিদ্রুপ করিয়া একবার তাহাকে চটাইয়া দিতে পারিলে তাহার ছুরির মত শাণিত ঝক্‌ঝকে বুদ্ধি সঙ্কোচ ও সংযমের পর্দা ছিঁড়িয়া বাহির হইয়া পড়ে, তখন তাহার কথাবার্তা সত্যই শুনিবার বস্তু হইয়া দাঁড়ায়।

আমি খোঁচা দিবার লোভ সামলাইতে পারিলাম না, বলিলাম–“ও, তাই না কি? কিন্তু খবরের কাগজওয়ালারা তাহলে ভারি শয়তান, সমস্ত কাগজখানা বিজ্ঞাপনে ভরে না দিয়ে কতকগুলো বাজে খবর ছাপিয়ে পাতা নষ্ট করে।”

ব্যোমকেশের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল–“তাদের দোষ নেই। তোমার মত লোকের চিত্তবিনোদন না করতে পারলে বেচারাদের কাগজ বিক্রি হয় না, তাই বাধ্য হয়ে ঐ সব খবর সৃষ্টি করতে হয়। আসল কাজের খবর থাকে কিন্তু বিজ্ঞাপনে। দেশের কোথায় কি হচ্ছে, কে কি ফিকির বার করে দিন-দুপুরে ডাকাতি করছে, কে চোরাই মাল পাচার করবার নূতন ফন্দি আঁটছে–এইসব দরকারী খবর যদি পেতে চাও তো বিজ্ঞাপন পড়তে হবে। রয়টারের টেলিগ্রামে ওসব পাওয়া যায় না।”

আমি হাসিয়া বলিলাম–“তা পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু,–থাক–। এবার থেকে না হয় বিজ্ঞাপনই পড়ব। কিন্তু তোমার মজার বিজ্ঞাপনটা কি শুনি?”

ব্যোমকেশ কাগজখানা আমার দিকে ছুঁড়িয়া দিয়া বলিল–“পড়ে দেখ, দাগ দিয়ে রেখেছি।”

পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে এক কোণে একটি অতি ক্ষুদ্র তিন লাইনের বিজ্ঞাপন দৃষ্টিগোচর হইল। লাল পেন্সিল দিয়া দাগ দেওয়া ছিল বলিয়াই চোখে পড়িল, নচেৎ খুঁজিয়া বাহির করিতে বিশেষ বেগ পাইতে হইত।

“পথের কাটা”

যদি কেহ পথের কাটা দূর করিতে চান, শনিবার সন্ধ্যা সাড়া পাঁচটার সময় হোয়াইটওয়ে লেড্‌ল’র দোকানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ল্যাম্পপোস্টে হাত রাখিয়ে দাঁড়াইয়া থাকিবেন।”

দুই-তিনবার পড়িয়াও বিজ্ঞাপনের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিতে পারিলাম না, বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম–“ল্যাম্পপোস্টে হাত রেখে মোড়ের মাথায় দাঁড়ালেই পথের কাঁটা দূর হয়ে যাবে! এ বিজ্ঞাপনের মানে কি? আর পথের কাঁটাই বা কি বস্তু?”

ব্যোমকেশ বলিল–“সেটা এখনও আবিষ্কার করতে পারিনি। বিজ্ঞাপনটা তিন মাস ধরে ফি শুক্রবার বার হচ্ছে, পুরনো কাগজ ঘাঁটলেই দেখতে পাবে।”

আমি বলিলাম–“কিন্তু এ বিজ্ঞাপনের সার্থকতা কি? কোনও একটা উদ্দেশ্য নিয়েই তো লোকে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে? এর তো কোন মানেই হয় না!”

ব্যোমকেশ বলিল–“আপাতত কোনও উদ্দেশ্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না বটে, কিন্তু তাই বলে উদ্দেশ্য নেই বলা চলে না। অকারণে কেউ গাঁটের কড়ি খরচ করে বিজ্ঞাপন দেয় না। –লেখাটা পড়লে একটা জিনিস সর্বাগ্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।”

“কি?”

“যে ব্যক্তি বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তার আত্মগোপন করবার চেষ্টা। প্রথমত দেখ, বিজ্ঞাপনে কোনও নাম নেই। অনেক অস্ময় বিজ্ঞাপনে নাম থাকে না বটে, কিন্তু খবরের কাগজের অফিসে খোঁজ নিলে নাম-ধাম সব জানতে পারা যায়। সে রকম বিজ্ঞাপনে বক্স-নম্বর দেওয়া থাকে। এতে তা নেই। তারপর দেখ, যে লোক বিজ্ঞাপন দেয়, সে জনসাধারণের সঙ্গে কোনও একটা কারবার চালাতে চায়–এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু মজা এই যে, এ লোকটি নিজে অদৃশ্য থেকে কারবার চালাতে চায়।”

“বুঝতে পারলুম না।”

“আচ্ছা, বুঝিয়ে বলছি, শোন। যিনি এই বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, তিনি জনসাধারণকে ডেকে বলছেন–‘ওহে, তোমরা যদি পথের কাঁটা দূর করত চাও তো অমুক সময় অমুক স্থানে দাঁড়িয়ে থেকো–এমনভাবে দাঁড়িয়ে থেকো–যাতে আমি তোমাকে চিনতে পারি।’–পথের কাঁটা কি পদার্থ, সে তর্ক এখন দরকার নেই, কিন্তু মনে কর তুমি ঐ জিনিসটা চাও। তোমার কর্তব্য কি? নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে ল্যাম্পপোস্ট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। মনে কর, তুমি যথাসময় সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলে। তারপর কি হল?”

“কি হল?”

“শনিবার বেলা পাঁচটার সময় ঐ জায়গায় কি রকম লোক-সমাগম হয় সেটা বোধ হয় তোমাকে বলে দিতে হব এনা। এদিকে হোয়াইটওয়ে নেড্‌ল, ওদিকে নিউ মার্কেট, চারিদিকে গোটা পাঁচ-ছয় সিনেমা হাউস। তুমি ল্যাম্পপোস্ট ধরে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইলে আর লোকের ঠেলা খেত এলাগলে, কিন্তু যে আশায় গিয়েছিলে, তা হল না–কেউ তোমার পথের কাঁটা উদ্ধার করয়াব্র মহৌষধ নিয়ে হাজির হল না। তুমি বিরক্ত হয়ে চলে এলে, ভাবলে, ব্যাপারটা আগাগোড়া ভূয়ো। তারপর হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে দেখলে, একখানা চিঠি কে ভিড়ের মধ্যে তোমার পকেটে ফেলে দিয়ে গেছে।”

“তারপর?”

“তারপর আর কি? চোরে-কামারে দেখা হল না অথচ সিঁধকাটি তৈরী হবার বন্দোবস্ত হয়ে গেল। বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে তোমার লেনদেনের সম্বন্ধ স্থাপিত হল অথচ তিনি কে, কি রকম চেহারা, তুমি কিছুই জানতে পারলে না।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়ে বলিলাম–“যদি তোমার যুক্তিধারাকে সত্যি বলেই মেনে নেওয়া যায়, তাহলে কি প্রমাণ হয়?”

“এই প্রমাণ হয়ে যে, ‘পথের কাটা’র সওদাগরটি নিজেকে অত্যন্ত সঙ্গোপনে রাখতে চান এবং যিনি নিজের পরিচয় দিতে এত সঙ্কুচিত, তিনি বিনয়ী হতে পারেন, কিন্তু সাধু-লোক কখনই নন।”

আমি মাথা নাড়িয়া বলিলাম–“এ তোমার অনুমান মাত্র, একে প্রমাণ বলতে পার না।”

ব্যোমকেশ উঠিয়া ঘরে পায়চারি করিতে করিতে কহিল,–“আরে, অনুমানই তো আসল প্রমাণ। যাকে তোমরা প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলে থাকো, তাকে বিশ্লেষণ করলে কতকগুলো অনুমান বৈয়ার কিছুই থাকে না। আইনে যে circumstantial evidence বলে একটা প্রমাণ আছে, সেটা কি? অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ তারই জোরে কত লোক যাবজ্জীবন পুলিপোলাও চলে যাচ্ছে।”

আমি চুপ করিয়া রইলাম, মন হইতে সায় দিতে পারিলাম না। অনুমান যে প্রত্যক্ষ প্রমাণের সমকক্ষ হইতে পারে, এ কথা সহজে মানিয়া লওয়া যায় না। অথচ ব্যোমকেশের যুক্তি খণ্ডন করাও কঠিন কাজ। সুতরাং নীরব থাকাই শ্রেয় বিবেচনা করিলাম। জানিতাম, এই নীরবতায় সে আরও অসহিষ্ণু হইয়া উঠিবে এবং অচিরাৎ আরো জোরালো যুক্তি আনিয়া হাজির করিবে।

একটা চড়াই পাখি কুটা মুখে করিয়া খোলা জানালার উপর আসিয়া বসিল এবং ঘাড় ফিরাইয়া ফিরাইয়া উজ্জ্বল ক্ষুদ্র চক্ষু দিয়া আমাদের পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। ব্যোমকেশ হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িয়া অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল–“আচ্ছা, ঐ পাখিটা কি চায় বলতে পার?”

আমি চমকিত হইয়া বলিলাম–“কি চায়? ওঃ, বোধহয় বাসা তৈরি করবার একটা জায়গা খুঁজছে।”

0 Shares