জীবন

চারিদিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর ,-
নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান !
ফসল উঠিছে ফ’লে ,- রসে রসে ভরিছে শিকড় ;
লক্ষ নক্ষত্রের সাথে কথা কয় পৃথিবীর প্রাণ !
সে কোন প্রথম ভোরে পৃথিবীতে ছিল যে সন্তান
অঙ্কুরের মতো আজ জেগেছে সে জীবনের বেগে !
আমার দেহের গন্ধে পাই তার শরীরের ঘ্রাণ ,-
সিন্ধুর ফেনার গন্ধ আমার শরীরে আছে লেগে !
পৃথিবী রয়েছে জেগে চক্ষু মেলে ,- তার সাথে সে-ও আছে জেগে !

নক্ষত্রের আলো জ্বেলে পরিষ্কার আকাশের’পর
কখন এসেছে রাত্রি !- পশ্চিমের সাগরের জলে
তার শব্দ ;- উত্তর সমুদ্র তার, – দক্ষিণ সাগর
তাহার পায়ের শব্দে- তাহার পায়ের কোলাহলে
ভ’রে ওঠে ;- এসেছে সে আকাশের নক্ষত্রের তলে
প্রথম যে এসেছিল , তারি মতো ;- তাহার মতন
চোখ তার ,- তাহার মতন চুল,- বুকের আঁচলে
প্রথম মেয়ের মতো ;- পৃথিবীর নদী মাঠ বন
আবার পেয়েছি তারে,- সমুদ্রের পারে রাত্রি এসেছে কখন !

সে এসেছে,- আকাশের শেষ আলো পশ্চিমের মেঘে
সন্ধ্যার গহ্বর খুঁজে পালায়েছে !- রক্তে রক্তে লাল
হয়ে গেছে বুক তার ,- আহত চিতার মতো বেগে
পালায়ে গিয়েছে রোদ ,- স’রে গেছে আলোর বৈকাল !
চ’লে গেছে জীবনের ‘আজ’ এক, – আর এক ‘কাল’
আসিত না যদি আর আলো লয়ে – রৌদ্র সঙ্গে লয়ে ! –
এই রাত্রি – নক্ষত্র সমুদ্র লয়ে এমন বিশাল
আকাশের বুক থেকে পড়িত না যদি আর ক্ষয়ে !-
রয়ে যেত, – যে গান শুনিনি আর তাহার স্মৃতির মতো হয়ে !

যে পাতা সবুজ ছিল – তবুও হলুদ হতে হয় ,-
শীতের হাড়ের হাত আজো তারে যায় নাই ছুঁয়ে ;-
যে মুখ যুবার ছিল ,- তবু যার হয়ে যায় ক্ষয় ,
হেমন্তের রাতের আগে ঝ’রে যায় ,- প’ড়ে যায় নুয়ে ;-
পৃথিবীর এই ব্যথা বিহ্বলতা অন্ধকারে ধুয়ে
পূর্ব সাগরের ঢেউয়ে ,- জলে জলে , পশ্চিম সাগরে
তোমার বিনুনি খুলে ,- হেঁট হয়ে ,- পা তোমার থুয়ে ,-
তোমার নক্ষত্র জ্বেলে ,- তোমার জলের স্বরে স্বরে
রয়ে যেতে যদি তুমি আকাশের নিচে ,- নীল পৃথিবীর’পড়ে !

ভোরের সূর্যের আলো পৃথিবীর গুহায় যেমন
মেঘের মতন চুল – অন্ধকার চোখের আস্বাদ
একবার পেতে চায় ;- যে –জন রয় না-যেই জন
চলে যায় , তারে পেতে আমাদের বুকে যেই সাধ ;-
যে ভালোবেসেছে শুধু , হয়ে গেছে হৃদয় অবাধ
বাতাসের মতো যার ,- তাহার বুকের গান শুনে
মনে যেই ইচ্ছা জাগে ;- কোনোদিন দেখে নাই চাঁদ
যেই রাত্রি ,- নেমে আসে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রেরে গুনে
যেই রাত্রি , আমি তার চোখে চোখ , চুলে তার চুল নেব বুনে !

তুমি রয়ে যাবে,- তবু,-অপেক্ষায় রয় না সময়
কোনোদিন;- কোনোদিন রবে না সে পথ থেকে স’রে !
সকলেই পথ চলে ,- সকলেই ক্লান্ত তবু হয় ;-
তবুও দু’জন কই ব’সে থাকে হাতে হাত ধ’রে !
তবুও দু’জন কই কে কাহারে রাখে কোলে ক’রে !
মুখে রক্ত ওঠে – তবু কমে কই বুকের সাহস !
যেতে হবে ,- কে এসে চুলের ঝুঁটি টেনে লয় জোরে !
শরীরের আগে কবে ঝ’রে যায় হৃদয়ের রস !-
তবু,- চলে ,- মৃত্যুর ঠোঁটের মতো দেহ যার হয়নি অবশ !

হলদে পাতার মতো আমাদের পথে ওড়াউড়ি !-
কবরের থেকে শুধু আকাঙ্ক্ষার ভূত লয়ে খেলা !-
আমরাও ছায়া হয়ে ,- ভূত হয়ে করি ঘোরাঘুরি !-
মনের নদীর পার নেমে আসে তাই সন্ধ্যাবেলা
সন্ধ্যার অনেক আগে ! – দুপুরেই হয়েছি একেলা !
আমরাও চরি-ফিরি কবরের ভূতের মতন !
বিকেলবেলার আগে ভেঙে গেছে বিকালের মেলা ,-
শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন !
হেমন্ত আসেনি মাঠে ,- হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন !

শীত – রাত ঢের দূরে ,- অস্থি তবু কেঁপে ওঠে শীতে !
শাদা হাত দুটো শাদা হাড় হয়ে মৃত্যুর খবর
একবার মনে আনে,- চোখ বুজে তবু কি ভুলিতে
পারি এই দিনগুলো ! – আমাদের রক্তের ভিতর
বরফের মতো শীত ,- আগুনের মতো তবু জ্বর !
যেই গতি ,- সেই শক্তি পৃথিবীর অন্তরে পঞ্জরে ;-
সবুজ ফলায়ে যায় পৃথিবীর বুকের উপর ,-
তেমনি স্ফুলিঙ্গ এক আমাদের বুকে কাজ করে !
শস্যের কীটের আগে আমাদের হৃদয়ের শস্য তবু মরে !

0 Shares