আরজ – কাজী নজরুল ইসলাম

আমার জীবনের সব চেয়ে বড়ো সাধ ছিল পবিত্র ‘কোরআন’ শরিফের বাংলা পদ্যানুবাদ করা। সময় ও জ্ঞানের অভাবে এতদিন তা করে উঠতে পারিনি। বহু বৎসরের সাধনার পর খোদার অনুগ্রহে অন্তত পড়ে বুঝবার মতোও আরবি-ফারসি ভাষা আয়ত্ত করতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

কোরআন শরিফের মতো মহাগ্রন্থের অনুবাদ করতে আমি কখনও সাহস করতাম না বা তা করবারও দরকার হত না – যদি আরবি ও বাংলা ভাষায় সমান অভিজ্ঞ কোনো যোগ্য ব্যক্তি এদিকে অবহিত হতেন।

ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র –– পুঁজি ধনরত্ন মণি-মাণিক্য সবকিছু – কোরআন মজিদের মণি-মঞ্জুষায় ভরা, তাও আবার আরবি ভাষার চাবি দেওয়া। আমরা – বাঙালি-মুসলমানেরা – তা নিয়ে অন্ধ-ভক্তিভরে কেবল নাড়াচাড়া করি। ওই মঞ্জুষা যে কোন মণিরত্নে ভরা, তার শুধু আভাসটুকু জানি! আজ যদি আমার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তিগণ এই কোরআন মজিদ, হাদিস, ফেকা প্রভৃতির বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন তাহলে বাঙালি-মুসলমানের তথা বিশ্ব-মুসলিম সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করবেন। অজ্ঞান-অন্ধকারের বিবরে পতিত বাঙালি মুসলমানদের তাঁরা বিশ্বের আলোক-অভিযানের সহযাত্রী করার সহায়তা করবেন। সে শুভদিন এলে আমার মতো অযোগ্য লোক এ বিপুল দায়িত্ব থেকে সানন্দে অবসর গ্রহণ করবে।

আমার বিশ্বাস, পবিত্র কোরআন শরিফ যদি সরল বাংলা পদ্যে অনূদিত হয়, তা হলে তা অধিকাংশ মুসলমানই সহজে কণ্ঠস্থ করতে পারবেন – অনেক বালক-বালিকাও সমস্ত কোরআন হয়তো মুখস্থ করে ফেলবে। এই উদ্দেশ্যেই আমি যতদূর সম্ভব সরল পদ্যে অনুবাদ করবার চেষ্টা করেছি। খুব বেশি কৃতকার্য যে হয়েছি তা বলতে পারিনে – কেননা কোরআন-পাঠের একটি শব্দও এধার-ওধার না করে তার ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে কবিতায় সঠিক অনুবাদ করার মতো দুরূহ কাজ আর দ্বিতীয় আছে কিনা জানিনে। কেননা আমার কলম, আমার ভাষা, আমার ছন্দ এখানে আমার আয়ত্তাধীন নয়।

মক্তব-মাদ্রাসা স্কুল-পাঠশালার ছেলে-মেয়েদের এবং স্বল্প-শিক্ষিত সাধারণের বোধগম্য ভাষাতেই আমি অনুবাদ করতে চেষ্টা করেছি। যদি আমার এই দিক দিয়ে এই প্রথম প্রচেষ্টাকে পাঠকবর্গ সাদরে গ্রহণ করেন – আমার সকল শ্রম সার্থক হল মনে করব।

আমি এই অনুবাদে যে যে পুস্তকের সাহায্য গ্রহণ করেছি, নীচে তার তালিকা দিলাম। –

Sale’s Quran, Moulana Md. Ali’s Quran, Tofsir-i-Hosainy, Tofsir-i-Baizabi, Tofsir-i-Kabiri, Tofsir-i-Azizi, Tofsir-i-Mowlana, Abdul Haque Dehlavi, Tofsir-i-Jalalain, etc., এবং মৌলানা মোহম্মদ আক্রাম খান ও মৌলানা রুহুল আমীন সাহেবের আমপারা।

বহু ভাগ্যগুণে আমি বিখ্যাত মেসার্স করিম বখ্‌শ ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মৌলানা আবদুর রহমান খান সাহেবের মতো দারাজ-দিল ও দারাজ-দস্ত মহানুভবের স্নেহ লাভ করেছি। প্রধানত তাঁরই উৎসাহে, অর্থে ও সাহায্যে আমি ‘আমপারা শরীফ’ অনুবাদ করতে পেরেছি। উক্ত বীর সাধকের যোগ্য পুত্র দেশ-বিখ্যাত কর্মী মউলবি রেজাউর রহমান খান এম. এ. বি. এল. (ডেপুটি প্রেসিডেন্ট, বেঙ্গল কাউন্সিল) সাহেবও অযাচিত স্নেহ ও প্রীতি-গুণে আমায় সর্ব বিষয়ে সাহায্য করে আমায় চির-কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। এঁদের ঋণ স্বীকার করবার মতো ভাষা ও সাধ্য আমার নেই।

মৌলানা মোহাম্মদ মোমতাজ উদ্দিন ফখ্‌রোল-মোহাদ্দেসীন সাহেব, মৌলানা সৈয়দ আবদুর রশীদ (পাব্‌নবি) সাহেব, মি. ইসকান্দর গজনবি বি. এ. সাহেব, মউলবি কে. এম. হেলাল সাহেব ও আরও অনেক সাহেবান তাঁদের অমূল্য সময়ের ক্ষতি করে অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে আমার এই অনুবাদে শুধু সাহায্য নয় সহযোগিতাও করেছেন, তাঁদের সাহায্য ব্যতিরেকে এ অনুবাদ হয়তো এতটা নির্ভুল হত না। এঁদের সকলকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও সম্মান নিবেদন করছি।

আমার সোদর-প্রতিম সাহিত্যিক আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্ন বি.এ. শুধু আমার প্রতি প্রীতিবশত যেভাবে এর জন্য আয়াস স্বীকার করেছেন, তার জন্য তাঁকে সর্বান্তঃকরণে আশীর্বাদ করছি। ইনি না থাকলে এ অনুবাদ হয়তো পুস্তক-আকারে আর বের হত না। এর প্রুফ দেখা, আমায় তাগিদ দিয়ে লেখানো ইত্যাদি সমস্ত কাজ আবদুল মজিদ দিবারাত্রি পরিশ্রম করে শেষ করেছেন।

পরম করুণাময় আল্লাহ্‌তালা এদের সকলের সকল বিষয়ে মঙ্গল করুন, ইহাই প্রার্থনা।

এ সত্ত্বেও যদি কোনো ভুল-ত্রুটি থাকে, মেহেরবান পাঠকবর্গের কেউ আমায় জানালে পরের সংস্করণে সানন্দে ঋণ স্বীকার করে তার সংশোধন করব। আরজ ইতি –

খাদেমুল ইসলাম—
নজরুল ইসলাম।

কলিকাতা, আগস্ট ১৯৩২

0 Shares