ছলনার ছন্দ

টেলিফোন তুলে নিয়ে ব্যোমকেশ বলল–’হ্যালো?

ইন্সপেক্টর রাখালবাবুর গলা শোনা গেল— ‘ব্যোমকেশদা‌, আমি রাখাল। নেতাজী হাসপাতাল থেকে কথা বলছি। একবার আসবেন?’

‘কি ব্যাপার?’

‘খুনের চেষ্টা। একটা লোককে কেউ গুলি করে মারবার চেষ্টা করেছিল‌, কিন্তু মারতে পারেনি। আহত লোকটাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। সে এক বিচিত্র গল্প বলছে।’

‘তাই নাকি? আচ্ছা‌, আমি যাচ্ছি।’

কেয়াতলায় ব্যোমকেশের বাড়ি থেকে নেতাজী হাসপাতাল বেশি দূর নয়। আধা ঘণ্টা পরে বিকেল আন্দাজ পাঁচটার সময় ব্যোমকেশ সেখানে পৌঁছে দেখল‌, এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে দারোগা রাখাল সরকার দাঁড়িয়ে আছেন।

এইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তিনি আরো কিছু তথ্য উদঘাটন করলেন। আহত লোকটির নাম গঙ্গাপদ চৌধুরী‌, ভদ্রশ্রেণীর লোক। ফ্রেজার রোড থেকে একটা ছোট রাস্তা বেরিয়েছে‌, সেই রাস্তায় একটা বাড়ির দোতলার ঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। বাড়ির ঠিকে চাকর বেলা তিনটের সময় কাজ করতে এসে গঙ্গাপদকে আবিষ্কার করে। তারপর হাসপাতাল পুলিস ইত্যাদি। গঙ্গাপদর জ্ঞান হয়েছে‌, কিন্তু প্রচুর রক্তপাতের ফলে এখনো ভারি দুর্বল।

গঙ্গাপদ আজ বিকেলবেলা তার দোতলার ঘরে রাস্তার দিকে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল‌, হঠাৎ সামনের দিক থেকে বন্দুকের গুলি এসে তার চুলের মধ্যে দিয়ে লাঙল চষে চলে যায়। খুলির ওপর গভীর টানা দাগ পড়েছে‌, কিন্তু গুলি খুলি ফুটো করে ভিতরে ঢুকতে পারেনি‌, হাড়ের ওপর দিয়ে পিছলে বেরিয়ে গেছে।

বন্দুকের গুলিটা ঘরের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছে‌, দেখে মনে হলো পিস্তল কিংবা রিভলবারের গুলি। পরীক্ষার জন্যে পাঠিয়েছে।

এবার চলুন গঙ্গাপদর বয়ান শুনবেন। তাকে খানিকটা রক্ত দেওয়া হয়েছে‌, এতক্ষণে সে বোধ হয় বেশ চনমনে হয়েছে।

গঙ্গাপদ চৌধুরী একটি ছোট ঘরে সঙ্কীর্ণ লোহার খাটের ওপর শুয়ে ছিল। মাথার ওপর পাগড়ির মত ব্যান্ডেজ‌, তার নীচে শীর্ণ লম্বাটে ধরনের একটি মুখ। মুখের রঙ বোধ করি রক্তপাতের ফলে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্ৰিশ। ভাবভঙ্গীতে ভালমানুষীর ছাপ।

ব্যোমকেশ ও রাখালবাবু খাটের দু’পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। গঙ্গাপদ একবার এর দিকে একবার ওর দিকে তাকাল; তার পাংশু অধরে একটুখানি ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল। লোকটি মৃত্যুর সিংদরজা থেকে ফিরে এসেছে‌, কিন্তু তার মুখে চোখে ত্ৰাসের কোনো চিহ্ন নেই।

রাখালবাবু বললেন–‘এঁর নাম ব্যোমকেশ বক্সী। ইনি আপনার গল্প শুনতে এসেছেন।’

গঙ্গাপদর চক্ষু হষোৎফুল্ল হয়ে উঠল‌, সে ধড়মড় করে উঠে বসবার চেষ্টা করলে ব্যোমকেশ তার বুকে হাত রেখে আবার শুইয়ে দিল‌, বলল—’উঠবেন না‌, শুয়ে থাকুন।’

গঙ্গাপদ বুকের ওপর দু’হাত জোড় করে সংহত সুরে বলল–’আপনি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশবাবু! কী সৌভাগ্য। আমার কলকাতা আসা সার্থক হলো।’

রাখালবাবু বললেন–‘আপনি যদি শরীরে যথেষ্ট বল পেয়ে থাকেন তাহলে ব্যোমকেশবাবুকে আপনার গল্প শোনান। আর যদি এখনো দুর্বল মনে হয় তাহলে থাক‌, আমরা পরে আবার আসব।’

গঙ্গাপদ বলল— ‘না না‌, আমার আর কোনো দুর্বলতা নেই। খুব খানিকটা রক্ত নাড়ির মধ্যে ঠুসে দিয়েছে কিনা।’ বলে হেসে উঠল।

‘তাহলে বলুন।’

খাটের পাশে টিপাইয়ের ওপর এক গ্লাস জল রাখা ছিল‌, গঙ্গাপদ বালিশের ওপর উচু হয়ে শুয়ে এক চুমুক জল খেলো‌, তারপর হাসি-হাসি মুখে গল্প বলতে আরম্ভ করল :

আমার নাম কিন্তু গঙ্গাপদ চৌধুরী নয়‌, অশোক মাইতি। কলকাতায় এসে আমি কেমন করে গঙ্গাপদ চৌধুরী বনে গেলাম সে ভারি মজার গল্প। বলি শুনুন।

আমার বাড়ি মীরাটে। সিপাহী যুদ্ধেরও আগে আমার পূর্বপুরুষ মীরাটে গিয়ে বাসা বেঁধেছিলেন। সেই থেকে আমরা মীরাটের বাসিন্দা‌, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক খুব বেশি নেই।

আমি মীরাটে সামান্য চাকরি করি। বাড়িতে বিধবা মা আছেন; আর একটি আইবুড়ো বোন। আমি বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে বিপত্নীক হয়েছি। আর বিয়ে করিনি। বোনটাকে পাত্রস্থ না করা পর্যন্ত

কিন্তু সে যাক। অফিসে এক মাস ছুটি পাওনা হয়েছিল‌, ভাবলাম কলকাতা বেড়িয়ে আসি। কলকাতায় আমার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ নেই; আমি ছেলেবেলায় একবার কলকাতায় এসেছিলাম‌, তারপর আর আসিনি। ভাবলাম স্বদেশ দেখাও হবে‌, আর সেই সঙ্গে বোনটার জন্যে যদি একটি পাত্র পাই—

হাওড়ায় এসে নোমলাম। মীরাট থেকে এক হিন্দুস্থানী ধর্মশালার ঠিকানা এনেছিলাম‌, ঠিক ছিল সেখানেই উঠিব। ট্রেন থেকে নেমে ফটকের দিকে চলেছি‌, দেখি একটা দাড়িওয়ালা লোক আমার পাশে পাশে চলেছে‌, আর ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে আমার পানে তাকাচ্ছে। একবার মনে হলো কিছু বলবে‌, কিন্তু মুখ খুলে কিছু না বলে আবার মুখ বন্ধ করল। আমি ভাবলাম‌, এ আবার কে? হয়তো হোটেলের দালাল।

ধৰ্মশালায় পৌঁছে কিন্তু মুশকিলে পড়ে গেলাম। সেখানে একটি কুঠুরিও খালি নেই‌, সব ভর্তি‌, এখন হোটেলে যেতে হয়; কিন্তু হোটেলে অনেক খরচ‌, অতি খরচ আমার পোষাবে না। কি করব ভাবছি‌, এমন সময় সেই দাড়িওয়ালা লোকটি এসে উপস্থিত। চোখে নীল চশমা। লাগিয়েছে। বলল–’জায়গা পেলেন না?’

বললাম-‘না। আপনি কে?’

সে বলল–’আমার নাম গঙ্গাপদ চৌধুরী। আপনি কোথা থেকে আসছেন?’

বললাম— ‘মীরাট থেকে। আমার নাম অশোক মাইতি। আপনি কি হোটেলের এজেন্ট?’

সে বলল— ‘না। হাওড়া স্টেশনে আপনাকে দেখেছিলাম‌, দেখেই চমক লেগেছিল। কেন চমক লেগেছিল। সে কথা পরে বলছি। এখন বলুন দেখি‌, কলকাতায় কি আপনার থাকবার জায়গা নেই?’

0 Shares