গোরা

শ্রাবণ মাসের সকালবেলায় মেঘ কাটিয়া গিয়া নির্মল রৌদ্রে কলিকাতার আকাশ ভরিয়া গিয়াছে। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার বিরাম নাই, ফেরিওয়ালা অবিশ্রাম হাঁকিয়া চলিয়াছে, যাহারা আপিসে কালেজে আদালতে যাইবে তাহাদের জন্য বাসায় বাসায় মাছ-তরকারির চুপড়ি আসিয়াছে ও রান্নাঘরে উনান জ্বালাইবার ধোঁওয়া উঠিয়াছে–কিন্তু তবু এত বড়ো এই-যে কাজের শহর কঠিন হৃদয় কলিকাতা, ইহার শত শত রাস্তা এবং গলির ভিতরে সোনার আলোকের ধারা আজ যেন একটা অপূর্ব যৌবনের প্রবাহ বহিয়া লইয়া চলিয়াছে।

এমন দিনে বিনা-কাজের অবকাশে বিনয়ভূষণ তাহার বাসার দোতলার বারান্দায় একলা দাঁড়াইয়া রাস্তায় জনতার চলাচল দেখিতেছিল। কালেজের পড়াও অনেক দিন চুকিয়া গেছে, অথচ সংসারের মধ্যেও প্রবেশ করে নাই, বিনয়ের অবস্থাটা এইরূপ। সভাসমিতি চালানো এবং খবরের কাগজ লেখায় মন দিয়াছে– কিন্তু তাহাতে সব মনটা ভরিয়া উঠে নাই। অন্তত আজ সকালবেলায় কী করিবে তাহা ভাবিয়া না পাইয়া তাহার মনটা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। পাশের বাড়ির ছাতের উপরে গোটা-তিনেক কাক কী লইয়া ডাকাডাকি করিতেছিল এবং চড়ুই-দম্পতি তাহার বারান্দার এক কোণে বাসা-নির্মাণ-ব্যাপারে পরস্পরকে কিচিমিচি শব্দে উৎসাহ দিতেছিল– সেই সমস্ত অব্যক্ত কাকলি বিনয়ের মনের মধ্যে একটা কোন্‌ অস্পষ্ট ভাবাবেগকে জাগাইয়া তুলিতেছিল।

আলখাল্লা-পরা একটা বাউল নিকটে দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া গান গাহিতে লাগিল–

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়,

ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়

বিনয়ের ইচ্ছা করিতে লাগিল বাউলকে ডাকিয়া এই অচিন পাখির গানটা লিখিয়া লয়, কিন্তু ভোর-রাত্রে যেমন শীত-শীত করে অথচ গায়ের কাপড়টা টানিয়া লইতে উদ্যম থাকে না, তেমনি একটা আলস্যের ভাবে বাউলকে ডাকা হইল না, গান লেখাও হইল না, কেবল ঐ অচেনা পাখির সুরটা মনের মধ্যে গুন্‌ গুন্‌ করিতে লাগিল।

এমন সময় ঠিক তাহার বাসার সামনেই একটা ঠিকাগাড়ির উপরে একটা মস্ত জুড়িগাড়ি আসিয়া পড়িল এবং ঠিকাগাড়ির একটা চাকা ভাঙিয়া দিয়া দৃকপাত না করিয়া বেগে চলিয়া গেল। ঠিকাগাড়িটা সম্পূর্ণ উল্‌টাইয়া না পড়িয়া এক পাশে কাত হইয়া পড়িল।

বিনয় তাড়াতাড়ি রাস্তায় বাহির হইয়া দেখিল গাড়ি হইতে একটি সতেরো-আঠারো বৎসরের মেয়ে নামিয়া পড়িয়াছে, এবং ভিতর হইতে একজন বৃদ্ধগোছের ভদ্রলোক নামিবার উপক্রম করিতেছেন।

বিনয় তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া নামাইয়া দিল, এবং তাঁহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেছে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার লাগে নি তো?”

তিনি “না, কিছু হয় নি” বলিয়া হাসিবার চেষ্টা করিলেন, সে হাসি তখনই মিলাইয়া গেল এবং তিনি মূর্ছিত হইয়া পড়িবার উপক্রম করিলেন। বিনয় তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিল ও উৎকণ্ঠিত মেয়েটিকে কহিল, “এই সামনেই আমার বাড়ি; ভিতরে চলুন।”

বৃদ্ধকে বিছানায় শোওয়ানো হইলে মেয়েটি চারি দিকে তাকাইয়া দেখিল ঘরের কোণে একটি জলের কুঁজা আছে। তখনই সেই কুঁজার জল গেলাসে করিয়া লইয়া বৃদ্ধের মুখে ছিটা দিয়া বাতাস করিতে লাগিল এবং বিনয়কে কহিল, “একজন ডাক্তার ডাকলে হয় না?”

বাড়ির কাছেই ডাক্তার ছিল। বিনয় তাঁহাকে ডাকিয়া আনিতে বেহারা পাঠাইয়া দিল।

ঘরের এক পাশে টেবিলের উপরে একটা আয়না, তেলের শিশি ও চুল আঁচড়াইবার সরঞ্জাম ছিল। বিনয় সেই মেয়েটির পিছনে দাঁড়াইয়া সেই আয়নার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।

বিনয় ছেলেবেলা হইতেই কলিকাতার বাসায় থাকিয়া পড়াশুনা করিয়াছে। সংসারের সঙ্গে তাহার যাহা-কিছু পরিচয় সে-সমস্তই বইয়ের ভিতর দিয়া। নিঃসম্পর্কীয়া ভদ্রস্ত্রীলোকের সঙ্গে তাহার কোনোদিন কোনো পরিচয় হয় নাই।

আয়নার দিকে চাহিয়া দেখিল, যে মুখের ছায়া পড়িয়াছে সে কী সুন্দর মুখ! মুখের প্রত্যেক রেখা আলাদা করিয়া দেখিবার মতো তাহার চোখের অভিজ্ঞতা ছিল না। কেবল সেই উদ্‌বিগ্ন স্নেহে আনত তরুণ মুখের কোমলতামণ্ডিত উজ্জ্বলতা বিনয়ের চোখে সৃষ্টির সদ্যঃপ্রকাশিত একটি নূতন বিস্ময়ের মতো ঠেকিল।

একটু পরে বৃদ্ধ অল্পে অল্পে চক্ষু মেলিয়া “মা” বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। মেয়েটি তখন দুই চক্ষু ছলছল করিয়া বৃদ্ধের মুখের কাছে মুখ নিচু করিয়া আর্দ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তোমার কোথায় লেগেছে?”

“এ আমি কোথায় এসেছি” বলিয়া বৃদ্ধ উঠিয়া বসিবার উপক্রম করিতেই বিনয় সম্মুখে আসিয়া কহিল, “উঠবেন না– একটু বিশ্রাম করুন, ডাক্তার আসছে।”

তখন তাঁহার সব কথা মনে পড়িল ও তিনি কহিলেন, “মাথার এইখানটায় একটু বেদনা বোধ হচ্ছে, কিন্তু গুরুতর কিছুই নয়।”

সেই মুহূর্তেই ডাক্তার জুতা মচ্‌ মচ্‌ করিতে করিতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; তিনিও বলিলেন, “বিশেষ কিছুই নয়।” একটু গরম দুধ দিয়া অল্প ব্রাণ্ডি খাইবার ব্যবস্থা করিয়া ডাক্তার চলিয়া যাইতেই বৃদ্ধ অত্যন্ত সংকুচিত ও ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার মেয়ে তাঁহার মনের ভাব বুঝিয়া কহিল, “বাবা, ব্যস্ত হচ্ছ কেন? ডাক্তারের ভিজিট ও ওষুধের দাম বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেব।”

বলিয়া সে বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল।

সে কী আশ্চর্য চক্ষু! সে চক্ষু বড়ো কি ছোটো, কালো কি কটা সে তর্ক মনেই আসে না– প্রথম নজরেই মনে হয়, এই দৃষ্টির একটা অসন্দিগ্ধ প্রভাব আছে। তাহাতে সংকোচ নাই, দ্বিধা নাই, তাহা একটা স্থির শক্তিতে পূর্ণ।

0 Shares