চোরাবালি

কুমার ত্ৰিদিবের বারংবার সনির্বন্ধ নিমন্ত্রণ আর উপেক্ষা করিতে না পারিয়া একদিন পৌষের শীত-সুতীক্ষ্ণ প্ৰভাতে ব্যোমকেশ ও আমি তাঁহার জমিদারীতে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম। ইচ্ছা ছিল দিন সাত-আট সেখানে নির্ঝঞ্ঝাটে কাটাইয়া, ফাঁকা জায়গার বিশুদ্ধ হওয়ায় শরীর চাঙ্গা করিয়া লইয়া আবার কলিকাতায় ফিরিব।

আদর যত্নের অবধি ছিল না। প্রথম দিনটা ঘণ্টায় ঘণ্টায় অপব্যাপ্ত আহার করিয়া ও কুমার ত্ৰিদিবের সঙ্গে গল্প করিয়াই কাটিয়া গেল। গল্পের মধ্যে অবশ্য খুড়া মহাশয় স্যার দিগিন্দ্ৰই বেশি স্থান জুড়িয়া রহিলেন।

রাত্রে আহারাদির পর শয়নঘরের দরজা পর্যন্ত আমাদের পৌঁছাইয়া দিয়া কুমার ত্ৰিদিব বলিলেন, ‘কাল ভোরেই শিকারে বেরুনো যাবে। সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি।’

ব্যোমকেশ সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘এদিকে শিকার পাওয়া যায় নাকি?’

ত্রিদিব বলিলেন‌, ‘যায়। তবে বাঘ-টাঘ নয়। আমার জমিদারীর সীমানায় একটা বড় জঙ্গল আছে‌, তাতে হরিণ‌, শুয়োর‌, খরগোশ পাওয়া যায়; ময়ূর‌, বনমুরগীও আছে। জঙ্গলটা চোরাবালির জমিদার হিমাংশু রায়ের সম্পত্তি। হিমাংশু আমার বন্ধু; আজ সকালে আমি তাকে চিঠি লিখে শিকার করবার অনুমতি আনিয়ে নিয়েছি। কোনো আপত্তি নেই তো?’

আমরা দুজনে একসঙ্গে বলিয়া উঠিলাম‌, ‘আপত্তি!’

ব্যোমকেশ যোগ করিয়া দিল‌, ‘তবে বাঘ নেই এই যা দুঃখের কথা।’

ত্রিদিব বলিলেন‌, ‘একেবারে যে নেই তা বলতে পারব না; প্রতি বছরই এই সময় দু’ একটা বাঘ ছিটকে এসে পড়ে—তবে বাঘের ভরসা করবেন না। আর বাঘ এলেও হিমাংশু আমাদের মারতে দেবে না‌, নিজেই ব্যাগ করবে।’ কুমার হাসিতে লাগিলেন—’জমিদারী দেখবার ফুরসৎ পায় না‌, তার এমনি শিকারের নেশা। দিন রাত হয় বন্দুকের ঘরে‌, নয় তো জঙ্গলে। যাকে বলে শিকার-পাগল। টিপও অসাধারণ–মাটিতে দাঁড়িয়ে বাঘ মারে।’

ব্যোমকেশ কৌতুহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কি নাম বললেন জমিদারীর-চোরাবালি? অদ্ভুত নাম তো।’

‘হ্যাঁ‌, শুনছি। ওখানে নাকি কোথায় খানিকটা চোরাবালি আছে‌, কিন্তু কোথায় আছে‌, কেউ জানে না। সেই থেকে চোরাবালি নামের উৎপত্তি। * হাতের ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন‌, শুরু কের নয়‌, শুয়ে পড়ুন। নইলে সকালে উঠতে কষ্ট হবে।’ বলিয়া একটা হই তুলিয়া প্ৰস্থান করিলেন।

একই ঘরে পাশাপাশি খাটে আমাদের শয়নের ব্যবস্থা হইয়াছিল। শরীর বেশ একটি আরামদায়ক ক্লান্তিতে ভরিয়া উঠিতেছিল; সানন্দে বিছানায় লেপের মধ্যে প্রবেশ করিলাম।

ঘুমাইয়া পড়িতেও বেশি দেরি হইল না। ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিলাম-চোরাবালিতে ডুবিয়া যাইতেছি; ব্যোমকেশ দূরে দাঁড়াইয়া হাসিতেছে। ক্ৰমে ক্রমে গলা পর্যন্ত ডুবিয়া গেল; যতই বাহির হইবার জন্য হাঁকপাক করিতেছি‌, ততই নিম্নাভিমুখে নামিয়া যাইতেছি। শেষে নাক পর্যন্ত বালিতে তলাইয়া গেল। নিমেষের জন্য ভয়াবহ মৃত্যু-যন্ত্রণার স্বাদ পাইলাম। তারপর ঘুম ভাঙিয়া গেল।

দেখিলাম‌, লেপটা কখন অসাবধানে নাকের উপর পড়িয়াছে। অনেকক্ষণ ঘমাক্ত কলেবরে বিছানায় বসিয়া রহিলাম‌, তারপর ঠাণ্ডা হইয়া আবার শয়ন করিলাম। চিন্তার সংসৰ্গ ঘুমের মধ্যেও কিরাপ বিচিত্ৰভাবে সঞ্চারিত হয় তাহা দেখিয়া হাসি পাইল।

ভোর হইতে না হইতে শিকারে বাহির হইবার হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল। কোনোমতে হাফ-প্যান্ট ও গরম হোস চড়াইয়া লইয়া‌, কেক সহযোগে ফুটন্ত চা গলাধঃকরণ করিয়া মোটরে চড়িলাম। মোটরে তিনটা শট-গান‌, অজস্র কার্তুজ ও এক বেতের বাক্স-ভরা আহাৰ্য দ্রব্য আগে হইতেই রাখা হইয়াছিল। কুমার ত্রিদিব ও আমরা দুইজন পিছনের সীটে ঠাসাঠাসি হইয়া বসিতেই গাড়ি ছাড়িয়া দিল। কুয়াশায় ঢাকা অস্পষ্ট শীতল উষালোকের ভিতর দিয়া হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিলাম।

কুমার ওভারকেটের কলারের ভিতর হইতে অস্ফুটম্বরে বলিলেন‌, ‘সুযোদয়ের আগে না। পৌঁছলে ময়ুর বনমোরগ পাওয়া শক্ত হবে। এই সময় তারা গাছের ডগায় বসে থাকে-চমৎকার ট্যাগেট।’

ক্ৰমে দিনের আলো ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। পথের দু’ধারে সমতল ধানের ক্ষেত; কোথাও পাকা ধান শোয়াইয়া দেওয়া হইয়াছে‌, কোথাও সোনালী মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দূরে আকাশের পটমূলে পুরু কালির দাগের মত বনানী দেখা গেল; আমাদের রাস্তা তাহার একটা কোণ স্পর্শ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। কুমার অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন যে ঐ বনেই শিকার করিতে চলিয়াছি।

মিনিট কুড়ি পরে আমাদের মোটর জঙ্গলের কিনারায় আসিয়া থামিল। আমরা পকেটে কার্তুজ ভরিয়া লইয়া বন্দুক ঘাড়ে মহা উৎসাহে বনের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলাম। কুমার ত্রিদিব একদিকে গেলেন। আমি আর ব্যোমকেশ এই সঙ্গে আর একদিকে চলিলাম। বন্দুক চালনায় আমার এই প্রথম হাতেখড়ি‌, তাই একলা যাইতে সাহস হইল না। ছাড়াছাড়ি হইবার পূর্বে স্থির হইল যে বেলা ন’টার সময় বনের পূর্ব সীমান্তে ফাঁকা জায়গায় তিনজনে আবার পুনর্মিলিত হইব। সেইখানেই প্রাতরাশের ব্যবস্থা থাকিবে।

প্ৰকাণ্ড বনের মধ্যে বড় বড় গাছ-শাল‌, মহুয়া‌, সেগুন‌, শিমূল‌, দেওদার-মাথার উপর যেন চাঁদোয়া টানিয়া দিয়াছে; তাহার মধ্যে অজস্র শিকার। নীচে হরিণ‌, খরগোশ-উপরে হরিয়াল‌, বনমোরগ‌, ময়ুর। প্রথম বন্দুক ধরিবার উত্তেজনাপূর্ণ আনন্দ-আওয়াজ করার সঙ্গে সঙ্গে বৃক্ষচুড়া হইতে মৃত পাখির পতন-শব্দ্‌্‌, ছররার আঘাতে উড্ডীয়মান কুকুটের আকাশে ডিগবাজী খাইয়া পঞ্চােত্ব প্রাপ্তি-একটা এপিক লিখিয়া ফেলিতে ইচ্ছা করিতেছে। কালিদাস সত্যই লিখিয়াছেন‌, বিধান্তি লক্ষ্যে চলে—সঞ্চরমান লক্ষ্যকে বিদ্ধ করা—এরূপ বিনোদ আর কোথায়? কিন্তু যাক-পাখি শিকারের বহুল বর্ণনা করিয়া প্রবীণ বাঘ-শিকারীদের কাছে আর হাস্যাস্পদ হইব না।

0 Shares