ব্যোমকেশের সহিত আমার একবার চকিত দৃষ্টি-বিনিময় হইল। সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া আড়মোড়া ভাঙিল, নন্দকে বলিল, ‘আচ্ছা নন্দ, তুমি আজ এস। অন্য সময় তোমার সঙ্গে আবার কথা হবে। ভাল কথা, তোমাদের ওস্তাদ পালিয়েছে। তুমি এখন কিছুদিন আর ওদিকে যেও না।’
নন্দ আবার ঠোঁট চাটিয়া বলিল, ‘আচ্ছা স্যার।’
৫
সমস্ত দিন ব্যোমকেশ অন্যমনস্ক হইয়া রহিল। বৈকালে সত্যবতী দু-একবার কাশ্মীর যাত্রার প্রসঙ্গ আলোচনা করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু ব্যোমকেশ শুনিতে পাইল না, ইজি-চেয়ারে শুইয়া কড়িকাঠের পানে তাকাইয়া রহিল।
আমি বলিলাম, ‘তাড়া কিসের? এ-ব্যাপারের আগে নিম্পত্তি হোক।’
সত্যবতী বলিল, ‘নিস্পত্তি হতে বেশি দেরি নেই। মুখ দেখে বুঝতে পারছি না।’
ব্যোমকেশ সত্যবতীর কথা শুনিতে পাইল কিনা বলা যায় না, আপন মনে ‘রাংতার চাকতি বলিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিল।
সত্যবতী আমার পানে অর্থপূর্ণ ঘাড় নাড়িয়া মুচকি হাসিল।
সন্ধ্যার পর থানায় ফোন করিবার কথা। আমি স্মরণ করাইয়া দিলে ব্যোমকেশ বলিল, ‘তুমিই ফোন করা অজিত।’
থানার নম্বর বাহির করিয়া ফোন করিলাম। ভবানীবাবু উপস্থিত ছিলেন, বলিলেন, ‘এইমাত্র রিপোর্ট এসেছে, মৃত্যুর সময় রাত্রি বারটা থেকে দুটোর মধ্যে। গুলিটা .৪৫ রিভলবারের, বাঁ দিকে স্ক্যাপিউলার নীচে দিয়ে ঢুকে হৃদযন্ত্র ভেদ করে ডান দিকের তৃতীয় পঞ্জরে আটকেছে। গুলির গতি নীচের দিক থেকে একটু ওপর দিকে, পাশের দিক থেকে মাঝের দিকে। —অন্য কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। —আর কি! পেটের মধ্যে খানিকটা মদ পাওয়া গেছে।’
ব্যোমকেশকে বলিলাম। সে কিছুক্ষণ অবাক হইয়া আমার পানে চাহিয়া রহিল, ‘গুলির গতি-কী বললে?’
‘নীচের দিক থেকে একটু ওপর দিকে, পাশের দিক থেকে মাঝের দিকে। অর্থাৎ যে গুলি করেছে সে রাস্তার বাঁদিকে ঝোপের মধ্যে বসেছিল, বসে বসেই গুলি করেছে।’
ব্যোমকেশ আরও কিছুক্ষণ তাকাইয়া রহিল, ‘উবু হয়ে বসে গুলি করেছে! কেন?’
‘তা জানি না। আমার সঙ্গে পরামর্শ করে গুলি করেনি।’
ধীরে বলিল, ‘ব্যাপারটা ভেবে দেখা। তোমাদের ধারণা আততায়ী আগে থেকে ফটকের ভিতর দিক লুকিয়ে ছিল, সত্যকাম ফটক দিয়ে ঢুকে কুড়ি-পঁচিশ ফুট রাস্তা পার হয়ে সদর দরজার সামনে এসে কড়া নাড়ল, তখন আততায়ী তাকে গুলি করল। আমার প্রশ্ন হচ্ছে–কেন? সত্যকাম যেই ফটক দিয়ে ঢুকল আততায়ী তখনই তাকে গুলি করল না কেন। তাতেই তো তার সুবিধে, গুলি করেই চটু করে ফটক দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার ভয়ও থাকত না।’
‘প্রশ্নের উত্তর কী–তুমিই বল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত এই যে, আততায়ী ওদিক থেকে গুলি করেনি। কিন্তু তার চেয়েও ভাবনার কথা, রাংতার চাকতিটা কে লাগিয়েছিল, কখন লাগিয়েছিল, এবং কেন লাগিয়েছিল।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ওটা তাহলে আকস্মিক নয়?’
‘যতাই ভাবছি ততাই মনে হচ্ছে ওটা আকস্মিক নয়, তার একটা গূঢ় অর্থ আছে। সেই অর্থ জানতে পারলেই সমস্যার সমাধান হবে।’
আমি বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম রাংতার চাকতির তাৎপৰ্য্য কী? যদি ধরা যায় আততায়ী ওটা লাগাইয়াছিল। তবে তাহার উদ্দেশ্য কী ছিল? যদি আততায়ী না লাগাইয়া থাকে। তবে কে লাগাইল? বাড়ির কেহ যদি না হয় তবে কে? সত্যকাম কি? কিন্তু কেন?
ব্যোমকেশ হঠাৎ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল, ‘অজিত, সত্যকামের সঙ্গে কী কী জিনিস ছিল–থানায় টেবিলের ওপর দেখেছিলে–মনে আছে?’
বলিলাম, ‘সিগারেট-কেস ছিল, রিস্টওয়াচ ছিল, মনিবাগ ছিল, মদের ফ্ল্যাস্ক ছিল আর-একটা ইলেকট্রিক টর্চ ছিল।’
ব্যোমকেশ আবার আস্তে আস্তে শুইয়া পড়িল, ইলেকট্রিক টর্চ–! কলকাতায় পথ চলাবার জন্যে ইলেকট্রিক টর্চ দরকার হয় না।’
‘না। কিন্তু ফটক থেকে সদর দরজা পর্যন্ত যেতে হলে দরকার হয়।’
ব্যোমকেশ একটু হাসিল, ‘তাহলে সত্যকাম টর্চের আলোয় আততায়ীকে দেখতে পায়নি কেন?’
সহসা এ-প্রশ্নের উত্তর যোগাইল না। কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল, তারপর ব্যোমকেশ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলিল, ‘কাল সকালে শীতাংশুর সঙ্গে নিভৃতে কথা বলা দরকার।’
আমি উচ্চকিতভাবে তাহার দিকে তাকাইয়া রহিলাম, কিন্তু সে আর কিছু বলিল না; বোধ করি কড়িকাঠ গুনিতে লাগিল। কিন্তু লক্ষ্য করিলাম, তাহার মুখের বিরস অন্যমনস্কতা আর নাই, যেন সে ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া দেখি ব্যোমকেশ কাহাকে ফোন করিতেছে। আমি চায়ের পেয়ালা লইয়া বাহিরের ঘরে আসিয়া বসিলে সেও আসিয়া বসিল। তাহার মুখ গম্ভীর।
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কাকে ফোন করছিলে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঊষাপতিবাবুকে।’
‘হঠাৎ ঊষাপতিবাবুকে?’
‘শীতাংশুকে পাঠিয়ে দিতে বললাম।’
‘ও।–ওদের বাড়ির খবর কী?’
‘খবর-পুলিস কাল সন্ধ্যেবেলা লাশ ফেরত দিয়েছিল–ওঁরা শেষ রাত্রে শ্মশান থেকে ফিরেছেন।’ ক্ষণেক চুপ করিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘কাল যদি পুলিস খানাতল্লাসি করত। তাহলে রিভলভারটা বোধ হয় বাড়িতেই পাওয়া যেত। এখন আর পাওয়া যাবে না।’
‘তার মানে বাড়ির লোকের কাজ।’
ব্যোমকেশ উত্তর দিল না।
আধ ঘণ্টা পরে শীতাংশু আসিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘এস-বোস। কাল তোমার মামার সামনে সব কথা জিজ্ঞাসা করতে পারিনি।’
শীতাংশু ব্যোমকেশের সামনের চেয়ারে বসিল এবং অপলক নেত্ৰে তাহার পানে চাহিয়া রহিল।
ব্যোমকেশ আরম্ভ করিল, ‘কাল থানায় খবর পেলুম তুমি নাকি দাঙ্গার সময় গোটা দুত্তিন খুন করেছ। কথাটা সত্যি?’