শীতাংশু উত্তর দিল না, কিন্তু ভয় পাইয়াছে বলিয়াও মনে হইল না; নির্ভীক একাগ্র চোখে চাহিয়া রহিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমাকে স্বচ্ছন্দে বলতে পোর, আমি পুলিসের লোক নই।’
শীতাংশুর গলাটা যেন ফুলিয়া উঠিল, সে চাপা গলায় বলিল, ‘হ্যাঁ। ওরা আমার বাবাকে–’
ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল, ‘জানি। কী দিয়ে খুন করেছিলে?’
‘ছোরা দিয়ে।’
‘তুমি কখনও রিভলভার ব্যবহার করেছ?’
‘না।’
‘সত্যকমের রিভলভার ছিল?’
‘জানি না। বোধহয় ছিল না।’
‘বাড়িতে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল কিনা জান?’
‘জানি না।’
‘সত্যকমের সঙ্গে তোমার সদ্ভাব ছিল?’
‘না। দু’জনে দু’জনকে এড়িয়ে চলতাম।’
‘সত্যকাম লম্পট ছিল তুমি জানতে?
‘জানতাম।’
‘তোমার বাবাকে তুমি ভালবাসতে। তোমার বোন চুমকিকেও নিশ্চয় ভালবাস?’
শীতাংশু উত্তর দিল না, কেবল চাহিয়া রহিল। ব্যোমকেশ হঠাৎ প্রশ্ন করিল, ‘সত্যকামকে খুন করবার ইচ্ছে তোমার কোনদিন হয়েছিল?’
শীতাংশু এবারও উত্তর দিল না, কিন্তু তাহার নীরবতার অর্থ স্পষ্টই বোঝা গেল। ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া বলিল বলতে হবে না, আমি বুঝেছি। সত্যকামকে তুমি বোধহয় শাসিয়ে দিয়েছিলে?’
শীতাংশু সহজভাবে বলিল, ‘হ্যাঁ। তাকে বলে দিয়েছিলাম, বাড়িতে বেচাল দেখলেই খুন করব।’
ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ তাহার পানে চাহিয়া রহিল; তীক্ষ্ণ চক্ষে নয়, যেন একটু অন্যমনস্কভাবে। তারপর বলিল, ‘সে-রাত্রে সহদেবের চীৎকার শুনে তুমি সদরে গিয়ে কি দেখলে?’
‘দেখলাম সত্যকাম দরজার বাইরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।’
‘কী করে দেখলে? সেখানে আলো ছিল?’
‘সত্যকমের হাতে একটা জ্বলন্ত টর্চ ছিল, তারই আলোতে দেখলাম। তারপর মামা এসে সদরের আলো জ্বেলে দিলেন।’
ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল। দুই-তিনটা লম্বা টান দিয়া বলিল, ‘ও-কথা যাক। সত্যকামকে নিয়ে তোমার মামা আর মামীর মধ্যে খুবই অশান্তি ছিল বোধহয়?’
‘অশান্তি–?’
‘হ্যাঁ। ঝগড়া বকবকি–এ-রকম অবস্থায় যা হয়ে থাকে।’
শীতাংশু একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘না, ঝগড়া বকাবিকি হত না।’
‘একেবারেই না?’
‘না। মামা আর মামীমার মধ্যে কথা নেই।’
ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলিল, ‘কথা নেই! তার মানে?’
‘মামা মামীমার সঙ্গে-কথা বলেন না, মামীমাও মামার সঙ্গে কথা বলেন না।’
‘সে কি, কবে থেকে?’
‘আমি যবে থেকে দেখছি। আগে যখন মানিকতলায় ছিলাম, প্রায়ই মামার বাড়ি আসতাম। তখনও মামা-মামীমাকে কথা বলতে শুনিনি।’
‘তোমার মামীম কেমন মানুষ? ঝগড়াটে?’
‘মোটেই না। খুব ভাল মানুষ।’
ব্যোমকেশ আর প্রশ্ন করিল না, চোখ বুজিয়া যেন ধ্যানস্থ হইয়া পড়িল। আমার মনে পড়িয়া গেল, কাল সকালবেলা ঊষাপতিবাবুর স্ত্রী সহসা ঘরে প্রবেশ করিলে তিনি বিস্ময়াহত চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া ছিলেন। তখন তাঁহার সেই চাহনির অর্থ বুঝিতে পারি নাই। …স্বামী-স্ত্রীর দীর্ঘ মনান্তর কি পুত্রের মৃত্যুতে জোড়া লাগিয়াছে?
শীতাংশু চলিয়া যাইবার পরও ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ চক্ষু মুদিয়া বসিয়া রহিল, তারপর নিশ্বাস ফেলিয়া চোখ মেলিল, ‘বড় ট্র্যাজিক ব্যাপার। —শীতাংশুকে কেমন মনে হল?’
‘মনে হল সত্যি কথা বলছে।’
‘ছেলেটা বুদ্ধিমান–ভারী বুদ্ধিমান।’ বলিয়া সে আবার ধ্যানস্থ হইয়া পড়িল।
আধা ঘণ্টা পরে তাহার ধ্যান ভাঙিল; বহিদ্বারের কড়া নাড়ার শব্দে। আমি উঠিয়া গিয়া দ্বার খুলিলাম। দেখি-ঊষাপতিবাবু।
৬
ব্যোমকেশের আহ্বানে ঊষাপতিবাবু চেয়ারে আসিয়া বসিলেন। ক্লান্ত অবসন্ন মূর্তি, চক্ষু দু’টি ঈষৎ রক্তাভ; শরীর যেন ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছে।
ব্যোমকেশ সিগারেটের কীেটা তাঁহার দিকে বাড়াইয়া দিল। দুইজনে কিছুক্ষণ অনুসন্ধিৎসু চক্ষে পরস্পরের প্রতি চাহিয়া রহিলেন, তারপর ঊষাপতিবাবু বলিলেন, ‘থাক, আমি এখনি উঠিব। আপনার ফোন পাবার পর থানায় গিয়েছিলাম, তা ওরা তো কোনও খবরই রাখে না। তাই ভাবলাম দেখি যদি আপনি কোনও খবর পেয়ে থাকেন।’
ঊষাপতিবাবুর কথায় যে প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন ছিল ব্যোমকেশ সরাসরি তাহার উত্তর দিল না, বলিল, ‘একদিনের কাজ নয়, সময় লাগবে। আপনার ওপর দিয়ে খুবই ধকল যাচ্ছে, আপনি আজ বাড়ি থেকে না বেরুলেই পারতেন। আপনার স্ত্রীকেও দেখা শোনা করা দরকার।’
ঊষাপতিবাবুর মুখ লক্ষ্য করিলাম, স্ত্রীর প্রসঙ্গে তাঁহার মুখের কোনও ভাবান্তর হইল না; স্ত্রীর সহিত তাঁহার যে দীর্ঘকালের বিপ্রয়োগ তাহার চিহ্নমাত্র দেখা গেল না। বলিলেন, ‘আমার স্ত্রীর জন্যেই ভাবনা। তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছেন। ‘ একটু থামিয়া বলিলেন, ‘ভাবছি কিছুদিনের জন্যে ওঁকে নিয়ে বাইরে ঘুরে এলে কেমন হয়। কলকাতার বাইরে গেলে হয়তে ওঁর মনটা—’
‘তা ঠিক। কোথায় যাবেন কিছু ঠিক করেছেন?’
‘না। কলকাতা ছেড়ে যেখানে হোক গেলেই বোধহয় কাজ হবে। কাশী বৃন্দাবন আগ্রা দিল্লী–। কিন্তু পুলিস আপত্তি করবে না তো?’
‘পুলিসকে বলে যাবেন। আমার বোধ হয় আপত্তি করবে না।’
‘যদি আপত্তি না করে, কাল পরশুর মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব। কলকাতা যেন বিষবৎ মনে হচ্ছে। —আচ্ছা নমস্কার।’ বলিয়া ঊষাপতিবাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার দোকান কি বন্ধ রাখবেন?’
‘দোকান-সুচিত্রা? না, বন্ধ রাখব কেন? দোকানের পুরনো খাজাঞ্চি ধনঞ্জয়বাবু আছেন। বিশ্বাসী লোক; তিনি চালাকেন। আমার ভাগনে শীতুকেও ভাবছি দোকানে ঢুকিয়ে নেব, পড়াশুনো করে আর কী হবে, দোকানটাই দেখুক! আর তো আমার কেউ নেই। ‘ নিশ্বাস ফেলিয়া তিনি দ্বারের পানে চলিলেন।