‘আপনি কি এখন দোকানের দিকে যাচ্ছেন?’
‘না, দোকানে এখন আর যাব না। ধনঞ্জয়বাবুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি।’
‘আসুন তাহলে—নমস্কার।’
ঊষাপতিবাবু প্রস্থান করিলেন। ব্যোমকেশ পর পর তিনটা সিগারেট নিঃশেষে ভস্মীভূত করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, ‘আমি একবার বেরুচ্ছি। তুমি বাড়িতেই থাক।’
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘সুচিত্রা এম্পেরিয়মে। খাজাঞ্চি ধনঞ্জয়বাবুর সঙ্গে আলাপ করা দরকার।’
ব্যোমকেশ যখন ফিরিল তখন দেড়টা বাজিয়া গিয়াছে। আমি স্নান সারিয়া অপেক্ষা করিতেছি, সত্যবতী অস্থিরভাবে ভিতর-বাহির করিতেছে। ব্যোমকেশ পাঞ্জাবিটা খুলিয়া ফেলিল, পাখা চালাইয়া দিয়া তক্তপোশের উপর লম্বা হইল। বসন্তকাল হইলেও দুপুরবেলার রৌদ্র বেশ কড়া।
বলিলাম, ‘খাজাঞ্চি মশায়ের সঙ্গে আলাপ বেশ জমে উঠেছিল দেখছি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। লোকটি কে জান? পরশু সুচিত্রার দোতলায় যে ক্যাশিয়ার আমাদের ক্যালমেমো কেটেছিল সেই।’
‘তাই নাকি? তা কী পেলে তার কাছ থেকে?’
‘পেলাম—’ ব্যোমকেশ ঘুরন্ত পাখার পানে চাহিয়া হাসিল, ‘একটা প্রীতি-উপহার।’
‘প্রীতি-উপহার!’
‘হ্যাঁ। কুড়ি পঁচিশ বছর আগে বিয়ের সময় প্রীতি-উপহার ছাপার খুব চলন ছিল, এখন কমে গেছে। ঘুড়ির কাগজের মত পিতপিতে কাগজের রুমালে লাল কালিতে ছাপা কবিতা, মাথার ওপর ডানা-মেলে-দেওয়া প্রজাপতির ছবি। দেখেছি নিশ্চয়।’
‘দেখেছি। খাজাঞ্চি মশায় এই প্ৰীতি-উপহার তোমাকে দিয়েছেন?’
‘হাঁ! ওই যে পাঞ্জাবির পকেটে রয়েছে, বার করে দেখ না।’
‘কিন্তু–কার বিয়ের প্রীতি-উপহার?’
‘পড়েই দেখ না।’
পাঞ্জাবির পকেট হইতে প্ৰীতি-উপহার বাহির করিলাম। পিতপিতে কাগজে লাল কালিতে ছাপা কবিতা, উপরে মুক্তপক্ষ প্রজাপতি, এবং তাহাকে ঘিরিয়া রামধনুর আকারে লেখা আছে–কুমারী সুচিত্রার সঙ্গে ঊষাপতির শুভ পরিণয়। তারপর কবিতা। এ-কবিতা পড়িয়া মানে বুঝিতে পারে এমন দিগ্গজ পণ্ডিত পৃথিবীতে নাই। সর্বশেষে কাব্য-রচয়িতার নাম, শ্ৰীধনঞ্জয় মণ্ডল ও সুচিত্রা এম্পেরিয়মের কর্মিবৃন্দ।
বলিলাম, এই কবিতার ঐতিহাসিক মূল্য থাকতে পারে। এ ছাড়া আর কিছু পেলে না?’
‘আর কিছুর দরকার নেই। এই প্রীতি-উপহারের মধ্যে সব কিছু আছে।’
‘কি আছে? আমি তো কিছু দেখছি না।’
‘হায় অন্ধ! ভাল করে দেখ।’
কবিতা আবার পড়িলাম। পড়িতে খুবই কষ্ট হইল, তবু পড়িলাম। তারপর বলিলাম, ‘এ-কবিতার মধ্যে যদি কোনও ইশারা ইঙ্গিত থাকে তার মানে বোঝা আমার কৰ্ম্ম নয়। সুচিত্রা নিশ্চয় ঊষাপতিবাবুর স্ত্রীর নাম, তার সঙ্গে ঊষাপতিবাবুর বিয়ে হওয়াতে ধনঞ্জয় মণ্ডল এবং সুচিত্রা এম্পেরিয়মের কর্মিবৃন্দ খুব আহ্বাদিত হয়েছিলেন, এইটুকুই আন্দাজ করছি।’
‘কবিতা নয়, তারিখ-তারিখ! বিয়ের তারিখটা দেখ।’
নীচের দিকে বাঁ কোণে লেখা ছিল :
কলিকাতা, ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২৭।
বলিলাম, ‘তারিখ দেখলাম, কিন্তু অজ্ঞানমসী দূর হল না।’
ব্যোমকেশ উঠিয়া বসিল, সত্যকাম তার জন্ম-তারিখ বলেছিল, মনে আছে?’
‘বলেছিল মনে আছে, কিন্তু তারিখটা মনে নেই।’
‘আমার মনে আছে।’
অধীর হইয়া উঠিলাম, ‘এ-সব সন-তারিখের মানে কী? সত্যকমের খুনের সঙ্গেই বা তার সম্পর্ক কী?
‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, ভেবে দেখ।’
‘ভেবে দেখতে পারি না। তুমি যদি বুঝে থাক কে খুন করেছে। পক্টাপষ্টি বল।’
‘তুমি বুঝতে পারছি না?’
না। কে খুন করেছে সত্যকামকে?’
‘ঊষাপতিবাবু।’
‘বাপ ছেলেকে খুন করেছে?’
‘করলেও অন্যায় হত না, কিন্তু সত্যকম ঊষাপতিবাবুর ছেলে নয়।’
মাথা গুলাইয়া গেল, কিছুক্ষণ জবুথবু হইয়া রহিলাম। তারপর সত্যবতী ভিতরের দরজা হইতে গলা বাড়াইয়া বলিল, ‘হ্যাঁগা, আজ কি তোমাদের উপোস?’
অপরাহ্নে চোরটের সময় আবার ঊষাপতিবাবু আসিলেন। এবারও অনাহূত আসিয়াছেন। সকালবেলার ক্লান্ত বিষন্নতা আর নাই, চক্ষে সতর্ক তীক্ষ্ণতা। তিনি আসিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে বসিলেন, কিছুক্ষণ শেনদৃষ্টিতে তাহাকে বিদ্ধ করিয়া বলিলেন, ‘আপনি ধনঞ্জয়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?’
‘ ব্যোমকেশ শান্তস্বরে বলিল, ‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।’
‘কী জানতে গিয়েছিলেন?’
‘যা জানতে গিয়েছিলাম তা জানতে পেরেছি।’
‘কী জানতে গিয়েছিলেন?’
‘সবই জানতে পেরেছি, ঊষাপতিবাবু। এমন কি দোরে আট রাংতার চাকতির তত্ত্বও অজানা নেই।’
ঊষাপতিবাবুর প্রশ্নের তীব্রতা যেন ধাক্কা খাইয়া থামিয়া গেল। তিনি আবার খানিকক্ষণ ব্যোমকেশের মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর সংবৃত স্বরে বলিলেন, ‘যা জানতে পেরেছেন তা আদালতে প্রমাণ করতে পারবেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার বিয়ের তারিখ আর সত্যকমের জন্মের তারিখ ছাড়া আর কিছু প্রমাণ করা যাবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাইনি, ঊষাপতিবাবু। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম। সত্যকাম আমাকে বলেছিল তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে, আসামীকে পুলিসে ধরিয়ে দেবার কোনও দায়িত্ব আমার নেই।’
ঊষাপতিবাবু স্থিরনেত্রে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিলেন, ধীরে ধীরে তাঁহার মুখভাবের পরিবর্তন হইল। এতক্ষণ তিনি যে যুদ্ধ করিবার জন্য উদ্যত হইয়াছিলেন, এখন সহসা অস্ত্র নামাইলেন। অবিশ্বাস-মিশ্ৰিত স্বরে বলিলেন, ‘আপনি যা জানতে পেরেছেন পুলিসকে তা বলবেন না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, পুলিস আমার সাহায্য চায় না, আমি কেন গায়ে পড়ে তাদের সাহায্য করতে যাব?’
ঊষাপতিবাবু পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া দুই হাতে রুমাল দিয়া মুখ ঢাকিলেন। তাঁহার শরীর দুই তিনবার অবরুদ্ধ আবেগে ঝাঁকানি দিয়া উঠিল। তারপর তিনি যখন মুখ খুললেন, তখন দেখিলাম তাঁহার মুখের চেহারা একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। দীর্ঘকাল রোগভোগের পর মরণাপন্ন রোগী প্রথম আরোগ্যের আশ্বাস পাইলে তাহার মুখে যে ভাব ফুটিয়া ওঠে ঊষাপতিবাবুর মুখেও সেই ভাব ফুটিয়া উঠিয়াছে। তিনি আরও কিছুক্ষণ নীরবে বসিয়া নিজেকে সামলাইয়া লইলেন, তারপর ভাঙা ভাঙা স্বরে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, সত্যকামের মৃত্যু কেন দরকার হয়েছিল। আপনি শুনবেন?’