রক্তের দাগ

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘শুনব। আপনি সব কথা বলুন।’

ঊষাপতিবাবু একবার কাতর চক্ষে আমার পানে চাহিলেন। তাঁহার চাহনির অর্থ : ব্যোমকেশের কাছে তিনি নিজের মর্ম কথা বলিতে রাজী থাকিলেও আর কাহারও সম্মুখে বলিতে অনিচ্ছুক। ব্যোমকেশ তাঁহার মনোভাব বুঝিয়া আমাকে বলিল‌, ‘অজিত‌, তুমি একবার হাওড়া স্টেশনে যাও‌, এনকোয়ারি অফিস থেকে জেনে এস কাশ্মীর যাওয়ার ব্যবস্থা কী রকম। কাশ্মীরে গণ্ডগোল চলছে‌, আগে থাকতে খবরাখবর নিয়ে রাখা ভাল।’

মনে মনে একটু নিরাশ হইলাম‌, তারপর জামা কাপড় বদলাইয়া বাহির হইয়া পড়িলাম।

হাওড়া স্টেশনের কাজ সারিয়া যখন ফিরিলাম। তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। সদর দরজা ভেজানো ছিল‌, প্রবেশ করিয়া দেখিলাম ঊষাপতিবাবু চলিয়া গিয়াছেন‌, ছায়াচ্ছন্ন ঘরের অপর প্রান্তে জানালার সামনে চেয়ার টানিয়া সত্যবতী ও ব্যোমকেশ ঘেঁষাঘেঁধি বসিয়া আছে। জানালা দিয়া ফুরফুরে দক্ষিণা বাতাস আসিতেছে। আমাকে দেখিয়া সত্যবতী একটু সরিয়া বসিল।

আমি কাছে আসিয়া বলিলাম‌, ‘বেশ তো কপোত-কপোতীর মত বসে মলয় মারুত সেবন করছ।–খোকা কোথায়?’

সত্যবতী একটু লজ্জিত হইয়া বলিল‌, ‘পুঁটিরাম খোকাকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দেখ অজিত‌, কবিদের কথা মিছে নয়। তাঁরা যে বসন্তঋতুর সমাগমে ক্ষেপে ওঠেন‌, তার যথেষ্ট কারণ আছে। মলয় মারুতে যুবক যুবতীরাই বেশি ঘায়েল হয় বটে কিন্তু বয়স্থ ব্যক্তিরাও বাদ পড়েন না। আমার বিশ্বাস‌, এটা যদি বসন্তকাল না হত তাহলে ঊষাপতিবাবু সত্যকামকে খুন করতেন কিনা সন্দেহ।’

বলিলাম‌, ‘বল কি! বসন্তকালের এমন মারাত্মক শক্তির কথা কবিরা তো কিছু লেখেননি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পষ্ট না লিখলেও ইশারায় বলেছেন। শক্তিমাত্রেই মারাত্মক; যে আগুন আলো দেয় সেই আগুনই পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে।–কিন্তু যাক‌, কাশ্মীরের খবর কী বল।’

বলিলাম‌, ‘কাশ্মীরে লড়াই বেধেছে‌, সাধারণ লোককে যেতে দিচ্ছে না। যেতে হলে ভারত সরকারের পারমিট চাই।’

আমি একটা চেয়ার আনিয়া ব্যোমকেশের অন্য পাশে বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পারমিট যোগাড় করা শক্ত হবে না। ভারত সরকারের সঙ্গে এখন আমার গভীর প্রণয়‌, অন্তত যতদিন বল্লভভাই প্যাটেল বেঁচে আছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে‌, সবাই মিলে কাশ্মীর যাওয়া কি ঠিক হবে? খোকা সবেমাত্র স্কুলে ঢুকেছে‌, গরমের ছুটিরও দেরি আছে। ওকে স্কুল কামাই করিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার উচিত মনে হচ্ছে না।’

সত্যবতী বলিল‌, ‘খোকা যাবে কেন? খোকা বাড়িতে থাকবে। ঠাকুরপো‌, তুমি খোকার দেখাশুনা করতে পারবে না?

আমি কিছুক্ষণ সত্যবতীর পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিলাম‌, ‘ও—এই মতলব। তোমরা দু’টিতে হংস-মিথুনের মত কাশ্মীরে উড়ে যাবে‌, আর আমি খোকাকে নিয়ে বাসায় পড়ে–থাকব। ভাই ব্যোমকেশ‌, তুমি ঠিক বলেছ‌, বসন্তঋতু বড় মারাত্মক ঋতু। কিন্তু কুছ পরোয়া নেই। যাও তোমরা টো টো করে বেড়াও গে‌, আমি খোকাকে নিয়ে মনের আনন্দে থাকব। সত্যি কথা বলতে কি‌, কাশ্মীর যাবার ইচ্ছে আমার একটুও ছিল না। বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বৰ্গ-জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’ বলিয়া একটা সিগারেট ধরাইয়া ফেলিলাম।

সত্যবতী ঠোঁটের উপর আঁচল চাপা দিয়া হাসি গোপন করিল। ব্যোমকেশ মৃদু গুঞ্জনে কবিতা আবৃত্তি করিল‌, ‘যৌবন মধুর কাল‌, আও বিনাশিবে কাল‌, কালে পিও প্ৰেম-মধু করিয়া যতন। —একটা সিগারেট দাও।’

সিগারেট দিয়া বলিলাম‌, ‘কবিতা পড়ে পড়ে তোমার চরিত্র খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু ও-কথা এখন থাক‌, ঊষাপতি যে নিজের চরিতামৃত শুনিয়ে গেলেন তা বলতে বাধা আছে কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিছুমাত্র না। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করেছিলাম। তোমাদের দু’জনকেই শোনাতে চাই। বড় মর্মান্তিক কাহিনী।’

সিগারেট ধরাইয়া ব্যোমকেশ বলিতে আরম্ভ করিল—

‘সত্যকাম আমার কাছে এসেছিল এক আশ্চর্য প্রস্তাব নিয়ে—আমার যদি হঠাৎ মৃত্যু হয় আপনি অনুসন্ধান করবেন। সে জানত কে তাকে খুন করতে চায়‌, কিন্তু তার নাম আমাকে বলল না। তখনই আমার মনে প্রশ্ন জাগল–নাম বলতে চায় না কেন? এখন জানতে পেরেছি‌, নাম না বলার গুরুতর কারণ ছিল‌, পারিবারিক কেচ্ছা বেরিয়ে পড়ত। সে যে জারজ‌, তার মা যে কলঙ্কিনী‌, এ-কথা সে প্রকাশ করতে পারেনি; নিজের মুখে নিজের কলঙ্ক-কথা কটা লোক প্রকাশ করতে পারে? সবাই তো আর সত্যযুগের সত্যকাম নয়।

‘তবু একটা ইঙ্গিত সে আমাকে দিয়ে গিয়েছিল—তার জন্ম-তারিখ। কিন্তু এমনভাবে দিয়েছিল যে‌, একবারও সন্দেহ হয়নি তার জন্ম-তারিখের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু-রহস্যের চাবি আছে। সে জানত‌, আমি যদি অনুসন্ধান আরম্ভ করি তাহলে জন্ম-তারিখটা আমার কাজে লাগবে। সত্যকাম বিবেকহীন লম্পট ছিল‌, কিন্তু তার বুদ্ধির অভাব ছিল না।

‘এবার গোড়া থেকে গল্পটা বলি। সত্যকমের জন্মের আগে থেকে সে-গল্পের সূত্রপাত। ঊষাপতিবাবুর মুখেই এ-গল্পের বেশির ভাগ শুনেছি‌, তবু গল্পটা যে সত্যি তাতে সন্দেহ নেই। তিনি নিজেকে রেয়াত করেননি‌, নিজের দোষ দুর্বলতা অকপটে ব্যক্ত করেছেন।

‘বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রমাকান্ত চৌধুরী সুচিত্রা এম্পেরিয়মের প্রতিষ্ঠা করেন। রমাকান্ত চৌধুরীর একমাত্র মেয়ের নাম সুচিত্রা‌, মেয়ের নামেই দোকানের নাম। চৌধুরী মশায় ভারী চতুর ব্যবসাদার ছিলেন‌, দু-চার বছরের মধ্যেই তাঁর দোকান ফেঁপে উঠল। ধর্মতলায় নতুন বাড়ি তৈরি হল‌, জমজমাট ব্যাপার। চৌধুরী মশায়ের সুচিত্রা এম্পেরিয়ম বিলাতি দোকানের সঙ্গে টেক্কা দিতে লাগল।

0 Shares