‘ঊষাপতি দাস ১৯২৫ সনে সামান্য শপ-অ্যাসিসট্যান্টের চাকরি নিয়ে সুচিত্রা এম্পেরিয়মে ঢোকেন। তখন তাঁর বয়স একুশ বাইশ; গরীবের ঘরের বাপ-মা-মরা ছেলে, লেখাপড়া বেশি শেখেননি। কিন্তু চেহারা ভাল, বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। দু-চার দিনের মধ্যেই তিনি দোকানের মাল বিক্রি করার কায়দাকানুন শিখে নিলেন, খদ্দেরকে কী করে খুশি রাখতে হয় তার কৌশল আয়ত্ত করে ফেললেন। সহকর্মীদের মধ্যে তিনি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। ক্রমে স্বয়ং কর্তার সুনজর পড়ল তাঁর ওপর। দু-চার টাকা করে মাইনে বাড়তে লাগল।
‘দু-বছর কেটে গেল। তারপর হঠাৎ একদিন ঊষাপতিবাবুর চরম ভাগ্যোদয় হল। রমাকান্ত চৌধুরী তাঁকে নিজের অফিস-ঘরে ডেকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই।’ এ-প্রস্তাব ঊষাপতির কল্পনার অতীত, তিনি যেন চাঁদ হাতে পেলেন। সেই যে রূপকথা আছে, পথের ভিখিরির সঙ্গে রাজকন্যের বিয়ে, এ যেন তাই। সুচিত্রাকে ঊষাপতি আগে অনেকবার দেখেছেন, সুচিত্রা প্রায়ই দোকানে আসতেন। ভারী মিষ্টি নরম চেহারা। ঊষাপতির মন রোমান্সের গন্ধে ভরে উঠল।
‘মাসখানেকের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল। খুব ধুমধাম হল। ঊষাপতির সহকর্মীরা প্ৰীতি-উপহার ছেপে বন্ধুকে অভিনন্দন জানালেন। ঊষাপতিবাবু এতদিন তাঁর বিবাহিতা বোনের বাড়িতে থাকতেন, এখন শ্বশুরবাড়িতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হল। শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়ি। রমাকান্ত চৌধুরী বড়মানুষ, তায় বিপত্নীক; তিনি মেয়েকে কাছ-ছাড়া করতে চান না।
‘টোপের মধ্যে বঁড়শি আছে। ঊষাপতি তা টের পেলেন ফুলশয্যার রাত্রে। রূপকথার স্বপ্ন-ইমারত ভেঙে পড়ল; বুঝতে পারলেন সুচিত্রা এম্পেরিয়মের কর্তা কেন দীনদরিদ্র কর্মচারীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ফুলের বিছানায় শয়ন করা হল না, ঊষাপতিবাবু সারা রাত্রি একটা চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিলেন। সকালবেলা শ্বশুরকে গিয়ে বললেন-আপনার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে, এবার আমাকে বিদায় দিন।
‘রম্যাকান্ত চৌধুরী ঘাড়েল ব্যবসাদার, তিনি বোধহয় প্রস্তুত ছিলেন; মোলায়েম সুরে জামাইকে বোঝাতে আরম্ভ করলেন-সুচিত্রা ছেলেমানুষ, মা-মরা মেয়ে; তার ওপর আজকাল দেশে যে হাওয়া বইতে শুরু করেছে তাতে মেয়েদের সামলে রাখাই দায়। সুচিত্রা খুবই ভাল মেয়ে, কেবল বর্তমান আবহাওয়ার দোষে একটু ভুল করে ফেলেছে। আজকাল ঘরে ঘরে এই ব্যাপার হচ্ছে, ঠগ বাছতে গাঁ উজোড়, কিন্তু বাইরের লোক কি জানতে পারে? সবাই বৌ নিয়ে মনের সুখ ঘরকন্না করে। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে নিজের মুখেই চুন-কালি পড়বে। অতএব—
‘ঊষাপতি কিন্তু কথায় ভুললেন না, বললেন, ‘আমায় মাপ করুন, আমি গরীব বটে। কিন্তু সদ্বংশের ছেলে। আমি পারব না।’
‘কথায় চিড়ে ভিজল না দেখে রমাকান্ত চৌধুরী ব্বহ্মাস্ত্র ছাড়লেন। দেরাজ থেকে ইস্টাম্বরি কাগজে লেখা দলিল বার করে বললেন, ‘আজ থেকে সুচিত্রা এম্পেরিয়মের তুমি আট আনা অংশীদার। এই দেখ দলিল। আমি মরে গেলে আমার যা কিছু সব তোমরাই পাবে, আমার তো আর কেউ নেই। কিন্তু আজ থেকে তুমি আমার পার্টনার হলে। দোকানে আমার হুকুম যেমন চলে তোমার হুকুমও তেমনি চলবে।’
‘ঊষাপতির মাথা ঘুরে গেল। রাজকন্যাটি দাগী বটে। কিন্তু হাতে হাতে অর্ধেক রাজত্ব। মোট কথা ঊষাপতি শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেলেন, সদ্য সদ্য অত টাকার লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি শ্বশুরবাড়িতে থাকতে রাজী হলেন। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক রইল না। সেই যে ফুলশয্যার রাত্রে দু-চারটে কথা হয়েছিল, তারপর থেকে কথা বন্ধ; শোবার ব্যবস্থাও আলাদা। বাইরের লোকে অবশ্য কিছু জানল না, ধোঁকার টাটি বজায় রইল।
‘রমাকান্ত যে বলেছিলেন সুচিত্রা ভাল মেয়ে, সে-কথা নেহাত মিথ্যে নয়। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাঁধন ভাঙার একটা ঢেউ এসেছিল, উচ্চবিত্ত সমাজের অবাধ মেলা-মেশা সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুচিত্ৰা আলোর নেশায় বিভ্রান্ত হয়ে একটু বেশি মাতামতি করেছিলেন। অভিভাবিকার অভাবে গণ্ডীর বাইরে যে পা দিচ্ছেন তা বুঝতে পারেননি। কিন্তু প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে তাঁর হুঁশ হল। বিয়ের পর তিনি বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, শান্ত সংযতভাবে বাড়িতে রইলেন। রমাকান্তের বাড়িতে লোক কম, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, কেবল রমাকান্ত, সুচিত্রা আর ঊষাপতি। স্থায়ী চাকরের মধ্যে সহদেব, আর বাকী বিপ্ন-চাকর শুকো। সহদেব চাকরিটার বুদ্ধিসুদ্ধি বেশি নেই, কিন্তু অটল তার প্রভু-পরিবারের প্রতি ভক্তি। তাই ঘরের কথা বাইরে চাউর হতে পেল না।
‘বিয়ের মাস দেড়েক পরে রমাকান্ত মেয়েকে নিয়ে বিলেত গেলেন। ওজুহাত দেখালেন, মেয়ের শরীর খারাপ, তাই চিকিৎসার জন্যে বিলেতে নিয়ে যাচ্ছেন। ঊষাপতি দোকানের সর্বময় কর্তা হয়ে কাজ চালাতে লাগলেন।
‘প্রায় এক বছর পরে রমাকান্ত বিলেত থেকে ফিরলেন। সুচিত্রার কোলে ছেলে। ছেলে দেখে বোঝা যায় না। তার বয়স দু-মাস কি পাঁচ মাস…
‘তারপর আমহার্স্ট স্ত্রীটের বাড়িতে ঊষাপতিবাবুর নীরস প্রাণহীন জীবনযাত্রা আরম্ভ হল। স্ত্রীর সঙ্গে সম্বন্ধ নেই, শ্বশুরের সঙ্গে কাজের সম্বন্ধ। দোকানটিকে ঊষাপতি প্ৰাণ দিয়ে ভালবাসলেন। তবু দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? অন্তরের মধ্যে ক্ষুধিত যৌবন হাহাকার করতে লাগল। ওদিকে সুচিত্রা সঙ্কুচিত হয়ে নিজেকে নিজের মধ্যে সংহরণ করে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে ঊষাপতি তাঁকে দেখতে পান, মনে হয় সুচিত্রা যেন কঠোর তপস্বিনী। তাঁর মনটা কোমল হয়ে আসে, তিনি জোর করে নিজেকে শক্ত রাখেন।