রক্তের দাগ

‘একটি একটি করে বছর কাটতে থাকে। সত্যকাম বড় হয়ে উঠতে লাগল। লম্পট বাপের উচ্ছৃঙ্খল রক্ত তার শরীরে‌, তার যত বয়স বাড়তে লাগল রক্তের দাগও তত ফুটে উঠতে লাগল। সব রকম রক্তের দাগ মুছে যায়‌, এ-রক্তের দাগ কখনও মোছে না। সত্যকাম কারুর শাসন মানে না‌, নিজের যা ইচ্ছে তাই করে; কিন্তু ভয়ানক ধূর্ত সে‌, কুটিল তার বুদ্ধি। দাদামশায়কে সে এমন বশ করেছে যে সব জেনেশুনেও তিনি কিছু বলতে পারেন না। সুচিত্রা শাসন করবার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ঊষাপতি সত্যকমের কোনও কথায় থাকেন না‌, সব সময় নিজেকে আলাদা করে রাখেন…স্ত্রীর কানীন পুত্রকে কোনও পুরুষই স্নেহের চক্ষে দেখতে পারে না। সত্যকামের স্বভাব চরিত্র যদি ভাল হত তাহলে ঊষাপতি হয়তো তাকে সহ্য করতে পারতেন‌, কিন্তু এখন তাঁর মন একেবারে বিষিয়ে গেল। সুচিত্রার সঙ্গে ঊষাপতির একটা ব্যবহারিকশ সংযোগের যদি বা কোনও সম্ভাবনা থাকত তা একেবারে লুপ্ত হয়ে গেল। ঊষাপতি আর সুচিত্রার মাঝখানে সত্যকাম ফণি-মনসার কাঁটা-বেড়ার মত দাঁড়িয়ে রইল।

‘সত্যকামের যখন উনিশ বছর বয়স‌, তখন রমাকান্ত মারা গেলেন‌, সত্যকামকে নিজের অংশ উইল করে দিয়ে গেলেন। এই সময় সত্যকাম নিজের জন্ম-রহস্য জানতে পারল। বিলেতে তার জন্ম হয়েছিল‌, সুতরাং বার্থ-সার্টিফিকেট ছিল। দাদামশায়ের কাগজপত্রের মধ্যে সেই বাৰ্থ-সার্টিফিকেট বোধহয় সে পেয়েছিল‌, তারপর পারিবারিক পরিস্থিতি দেখে আসল ব্যাপার বুঝে নিয়েছিল। সে বাইরে ভারী কেতাদুরস্ত ছেলে‌, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীষণ কুটিল আর হিংসুক। ঊষাপতি আর সুচিত্রার প্রতি তার ব্যবহার হিংস্র হয়ে উঠল। একদিন সে নিজের মাকে স্পষ্টই বলল‌, ‘তুমি আমাকে শাসন করতে আস কোন লজ্জায়! আমি সব জানি।’ ঊষাপতিকে বলল‌, ‘আপনি আমার বাপ নন‌, আপনাকে খাতির করব কিসের জন্যে?’

‘বাড়িতে ঊষাপতি আর সুচিত্রার জীবন দুৰ্বহ হয়ে উঠল। ওদিকে দোকানে গিয়ে সত্যকাম আর-একরকম খেলা দেখাতে আরম্ভ করল। সে এখন দোকানের অংশীদার‌, ঊষাপতির সঙ্গে তার অধিকার সমান। সে নিজের অধিকার পুরোদস্তুর জারি করতে শুরু করল। সুচিত্রার মত শৌখিন দোকানে পুরুষের চেয়ে মেয়ে খদ্দেরেরই ভিড় বেশি; সত্যকাম তাদের মধ্যে থেকে কমবয়সী সুন্দর মেয়ে বেছে নিত, তাদের সঙ্গে ভাব করত, দোকানের দামী জিনিস সস্তায় তাদের বিক্রি করত‌, হোটেলে নিয়ে গিয়ে তাদের খাওয়াত। দোকানের তহবিল থেকে যখন যত টাকা ইচ্ছে বার করে দু-হাতে ওড়াত। মদ‌, ঘোড়দৌড়‌, বড় বড় ক্লাবে গিয়ে জুয়া খেলা তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবসা হয়ে উঠল।

‘রমাকান্তর মৃত্যুর পর বছরখানেক যেতে না যেতেই দেখা গেল দোকানের অবস্থা খারাপ হয়ে আসছে‌, আর বেশি দিন এভাবে চলবে না। ঊষাপতিবাবু বাধা দিতে গেলে সত্যকাম বলে‌, ‘আমার টাকা আমি ওড়াচ্ছি‌, আপনার কী?’ উপরন্তু দোকানের একটা বদনাম রটে গেল‌, মেয়েদের ও-দোকানে যাওয়া নিরাপদ নয়। খদ্দের কমে যেতে লাগল। বিভ্রান্ত ঊষাপতিবাবু কী করবেন ভেবে পেলেন না।

‘পরিস্থিতি যখন অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে‌, তখন একটি ব্যাপার ঘটল। একদিন সন্ধ্যার পর কী একটা কাজে ঊষাপতি বাড়িতে এসেছেন‌, ওপরে নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে শুনতে পেলেন পাশের ঘর থেকে একটা অবরুদ্ধ কাতরানি আসছে। পাশের ঘরটা তাঁর স্ত্রীর ঘর। পা টিপে টিপে ঊষাপতি দোরের কাছে গেলেন। দেখলেন‌, তাঁর স্ত্রী একলা মেঝেয় মাথা কুটছেন। আর বলছেন‌, ‘এখনো কি আমার প্রায়শ্চিত্ত শেষ হয়নি? আর যে আমি পারি না?’

‘ঊষাপতি চুপি চুপি নীচে নেমে গেলেন। সহদেবকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন‌, সন্ধ্যার আগে পাড়ার একটি বর্ষীয়সী ভদ্রমহিলা এসেছিলেন‌, তিনি সুচিত্রাকে যাচ্ছেতাই অপমান করে গেছেন। মহিলাটির মেয়েকে নাকি সত্যকাম সিনেমা দেখাচ্ছে আর বিলিতি হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াচ্ছে।

‘সেই দিন ঊষাপতি সংকল্প করলেন‌, সত্যকামকে সরাতে হবে। তাকে খুন না করলে কোনও দিক দিয়েই নিস্তার নেই। এভাবে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।

‘ঊষাপতি তৈরি হলেন। তাঁর একটা সুবিধে ছিল‌, সত্যকাম যদি খুন হয় তাঁকে কেউ সন্দেহ করবে না। বাইরে সবাই জানে সত্যকাম তাঁর ছেলে‌, বাপ ছেলেকে খুন করেছে। এ-কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সত্যকমের অনেক শত্ৰু‌, সন্দেহটা তাদের উপর পড়বে। তবু এমনভাবে কাজ করা দরকার‌, যাতে কোনও মতেই তাঁর পানে দৃষ্টি আকৃষ্ট না হয়।

‘ঊষাপতি একটি চমৎকার মতলব বার করলেন। একজন চেনা গুণ্ডার কাছ থেকে একটি রিভলভার যোগাড় করলেন। ছেলেবেলায় কিছুদিন তিনি সস্ত্ৰাসবাদীদের দলে মিশেছিলেন‌, রিভলভার চালানোর অভ্যাস ছিল; তিনি কয়েকবার বেলঘরিয়ার একটা আম-বাগানে গিয়ে অভ্যাসটা ঝালিয়ে নিলেন। তারপর সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

‘সত্যকাম ঝানু ছেলে‌, সে ঊষাপতির মতলব বুঝতে পারল; কিন্তু নিজেকে বাঁচাবার কোনও উপায় খুঁজে পেল না। পুলিসের কাছে গেলে নিজের জন্ম-রহস্য ফাঁস হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সে হতাশ হয়ে আমার কাছে এসেছিল। ঊষাপতিবাবু অবশ্য সে-খবর জানতেন না।

‘যে-রাত্রে সত্যকাম খুন হয়‌, সে-রাত্রিটা ছিল শনিবার। শনিবারে সত্যকাম অন্য রাত্রির চেয়ে দেরি করে বাড়ি ফেরে‌, সুতরাং শনিবারই প্রশস্ত। ঊষাপতিবাবু একটি রাংতার চাকতি তৈরি করে রেখেছিলেন; রাত্রি সাড়ে দশটার সময় যখন সহদেব রান্নাঘরে খেতে গিয়েছে‌, তখন তিনি চুপি চুপি নেমে এসে সেটি দরজার কপাটে জুড়ে দিয়ে আবার নিঃশব্দে উপরে উঠে গেলেন। সদর দরজা যেমন বন্ধ ছিল তেমনি বন্ধ রইল‌, বাহিরে যে রাংতার চাকতি সাঁটা হয়েছে তা কেউ জানতে পারল না। শুকো ঝি আর রাঁধুনি তার অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছে।

0 Shares