রক্তের দাগ

‘সহদেব খাওয়া-দাওয়া শেষ করে খিড়কির দরজায় তালা লাগাল‌, তারপর সদর বারান্দায় গিয়ে বিছানা পেতে শুল। ওপরে ঊষাপতিবাবু নিজের ঘরে আলো নিভিয়ে অপেক্ষা করে রইলেন, সামনের দিকের ব্যালকনির দরজা খুলে রাখলেন।

‘দু-ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ফটকের কাছে শব্দ হল‌, সত্যকাম আসছে। ঊষাপতি ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে ঘাপটি মেরে রইলেন। ফটিক থেকে সদর দরজা পর্যন্ত রাস্তা অন্ধকার‌, সত্যকাম টর্চ জ্বেলে দেখতে দেখতে এগিয়ে আসছে। সদর দরজায় টোকা মেরে হঠাৎ তার নজরে পড়ল দরজার নীচের দিকে টাকার মত একটা চাকতি টর্চের আলোয় চকচক করছে। সে সামনের দিকে ঝুকে সেটা দেখতে গেল। অমনি ঊষাপতিবাবু ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে গুলি করলেন। রিভলভারের গুলি সত্যকামের পিঠ ফুটো করে বুকের হাড়ে গিয়ে আটকাল। সত্যকাম সেইখানেই মুখ থুবড়ে পড়ল‌, হাতের জ্বলন্ত টর্চটা জ্বলতেই রইল।

‘এই হল সত্যকমের মৃত্যুর প্রকৃত ইতিহাস। ঊষাপতিবাবু এমন কৌশল করেছিলেন যে‌, লাশ পরীক্ষা করে মনে হবে পিছন দিক থেকে কেউ তাকে গুলি করেছে‌, ওপর দিক থেকে গুলি করা হয়েছে তা কিছুতেই বোঝা যাবে না। রাংতার চাকতিটা যদি না থাকত আমিও বুঝতে পারতাম না।’

ব্যোমকেশ চুপ করিল। আমরাও অনেকক্ষণ নীরব রহিলাম। তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া সত্যবতী বলিল‌, ‘তুমি প্রথম কখন ঊষাপতিবাবুকে সন্দেহ করলে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ হয়েছিল‌, বাড়ির লোকের কাজ। যদি বাইরের লোকের কাজ হবে‌, তাহলে সত্যকাম হত্যাকারীর নাম বলবে না কেন? তখনই আমার মনে হয়েছিল। এই সংকল্পিত হত্যার পিছনে এক অতি গুহ্য পারিবারিক কলঙ্ক-কাহিনী লুকিয়ে আছে।

‘তারপর জানতে পারলাম, ঊষাপতি আর সুচিত্রার দাম্পত্য জীবন স্বাভাবিক নয়। দীর্ঘকাল ধরে তাঁদের মধ্যে বাক্যালাপ বন্ধ‌, শোবার ঘরও আলাদা। মনে খটকা লাগল। খাজাঞ্চি মশায়ের সঙ্গে আলাপ জমালাম। লোকটি ঊষাপতিবাবুর দরদী বন্ধু; তিনিই একুশ বছর আগে বন্ধুর বিয়েতে প্রীতি-উপহার লিখেছিলেন। প্ৰীতি-উপহারটি খাজাঞ্চি মশাই খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন‌, কারণ এটি তাঁর প্রথম এবং একমাত্র কবি-কীর্তি। আমি যখন প্রীতি-উপহারটি হাতে পেলাম‌, তখন আর কোনও সংশয় রইল না। সত্যকমের জন্ম-তারিখ মনে ছিল-৭ই জুলাই‌, ১৯২৭)। আর বিয়ের তারিখ ১৩ই ফেব্রুয়ারি‌, ১৯২৭। অর্থাৎ বিয়ের পর পাঁচ পাস পূর্ণ হবার আগেই ছেলে হয়েছে। ধূর্ত রমাকান্ত কেন দরিদ্র কর্মচারীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন বুঝতে কষ্ট হয় না।

‘সত্যকাম ঊষাপতির ছেলে নয়‌, সুতরাং তাকে খুন করার পক্ষে ঊষাপতির কোনও বাধা নেই। কিন্তু তিনি খুন করলেন কী করে? যখন জানতে পারলাম মৃত্যুকালে সত্যকামের হাতে জ্বলন্ত টর্চ ছিল‌, তখন এক মুহুর্তে রাংতার চাকতির উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গেল। সত্যকমের টর্চের আলো দোরের ওপর পড়েছিল‌, রাংতার চাকতিটা চকমক করে উঠেছিল‌, সত্যকাম সামনে ঝুঁকে দেখতে গিয়েছিল ওটা কি চকমক করছে। ব্যস—!’

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। আমি ব্যোমকেশকে সিগারেট দিয়া নিজে একটা লইলাম‌, দু’জনে টানিতে লাগিলাম। ঘর সম্পূর্ণ অন্ধকার হইয়া গিয়াছে‌, দখিনা বাতাস চুপি চুপি আমাদের ঘিরিয়া খেলা করিতেছে।

হঠাৎ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আজ ঊষাপতিবাবু যাবার সময় আমার হাত ধরে বললেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আমি আর আমার স্ত্রী জীবনে বড় দুঃখ পেয়েছি‌, একুশ বছর ধরে শ্মশানে বাস করেছি। আজ আমরা অতীতকে ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে চাই‌, একটু সুখী হতে চাই। আপনি আর জল ঘোলা করবেন না।’ আমি ঊষাপতিবাবুকে কথা দিয়েছি‌, জল ঘোলা করব না। কাজটা হয়তো আইনসঙ্গত হচ্ছে না। কিন্তু আইনের চেয়েও বড় জিনিস আছে–ন্যায়ধর্ম। তোমাদের কী মনে হয়? আমি অন্যায় করেছি?’

সত্যবতী ও আমি সমস্বরে বলিলাম‌, ‘না।’

(সমাপ্ত)

0 Shares