যুবকের মুখে চকিত হাসি খেলিয়া গেল। হাসিটি বেশ চিত্তাকর্ষক। সে বলিল, ‘নামটা এখনও বলা হয়নি। আমার নাম সত্যকাম দাস।’
‘সত্যকাম?’
‘হ্যাঁ! আপনি যেমন সত্যান্বেষী, আমি তেমনি সত্যকাম।’
‘এ-নাম আগে শুনিনি। সত্যকাম ছদ্মনাম নয় তো?’
‘না, আসল নাম।’
‘হুঁ। আপনি কোথায় থাকেন? ঠিকানা কি?’
‘কলকাতায় থাকি।। ৩৩/৩৪ আমহার্স্ট স্ট্রীট।’
‘কী কাজ করেন।’
‘কাজ? বিশেষ কিছু করি না। দাস-চৌধুরী কোম্পানির সুচিত্রা এম্পেরিয়মের নাম শুনেছেন?’
‘শুনেছি। ধর্মতলা স্ত্রীটের বড় মনিহারী দোকান।’
‘আমি সুচিত্রা এম্পেরিয়মের অংশীদার।’
‘অংশীদার।–অন্য অংশীদার কে?’
সত্যকাম একবার দাম লইয়া বলিল, ‘আমার বাবা–ঊষাপতি দাস।’
ব্যোমকেশ সপ্রশ্ন নেত্ৰে চাহিয়া রহিল। সত্যকাম তখন ক্ষণেকের জন্য ইতস্তত করিয়া
তাঁর পার্টনার হন। এখন দাদামশাই মারা গেছেন, তাঁর অংশ আমাকে দিয়ে গেছেন। আমার মা দাদামশায়ের একমাত্র সন্তান। আমিও মায়ের একমাত্র সন্তান।’
‘বুঝেছি।’ ব্যোমকেশ ক্ষণকাল যেন অন্যমনস্ক হইয়া রহিল, তারপর নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি মদ খান?’
কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হইয়া সত্যকাম বলিল, ‘খাই। গন্ধ পেলেন বুঝি?’
‘আপনার বয়স কত?’
‘জন্ম-তারিখ জানতে চান? ৭ই জুলাই, ১৯২৭।’ সত্যকাম ব্যঙ্গবঙ্কিম হাসিল।
‘কতদিন মদ খাচ্ছেন?’
‘চৌদ্দ বছর বয়সে মদ ধরেছি।’। সত্যকাম নিঃশেষিত সিগারেটের প্রান্ত হইতে নূতন সিগারেট ধরাইল।
‘সব সময় মদ খান?’
‘যখন ইচ্ছে হয় তখনই খাই।’ বলিয়া সে পকেট হইতে চার আউন্সের একটি ফ্ল্যাস্ক বাহির করিয়া দেখাইল।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া বসিয়া রহিল। আমিও নিবকিভাবে এই একুশ বছরের ছোকরাকে দেখিতে লাগিলাম। যাহারা সর্বাং লজ্জাং পরিত্যজ্য ত্ৰিভুবন বিজয়ী হইতে চায়, তাহারা বোধকরি খুব অল্প বয়স হইতেই সাধনা আরম্ভ করে।
ব্যোমকেশ মুখ তুলিয়া পূর্ববৎ নির্বিকার স্বরে বলিল, ‘আপনার আনুষঙ্গিক দোষও আছে?’
সত্যকাম মুচকি হাসিল, ‘দোষ কেন বলছেন, ব্যোমকেশবাবু? এমন সর্বজনীন কাজ কি দোষের হতে পারে?’
আমার গা রি-রি করিয়া উঠিল। ব্যোমকেশ কিন্তু নির্বিকার মুখেই বলিল, ‘দার্শনিক আলোচনা থাক। ভদ্রঘরের মেয়েদের উপরেও নজর দিয়েছেন?’
‘তা দিয়েছি।’ সত্যকামের কণ্ঠস্বরে বেশ একটু তৃপ্তির আভাস পাওয়া গেল।
‘কত মেয়ের সর্বনাশ করেছেন?’
‘হিসাব রাখিনি, ব্যোমকেশবাবু।’ বলিয়া সত্যকাম নির্লজ্জ হাসিল।
ব্যোমকেশ মুখের একটা অরুচিসূচক ভঙ্গী করিল, ‘আপনি বলছেন। হঠাৎ আপনার মৃত্যু হতে পারে। কেউ আপনাকে খুন করবে, এই কি আপনার আশঙ্কা?’
‘হ্যাঁ।’
‘কে খুন করতে পারে? যে-মেয়েদের অনিষ্ট করেছেন তাদেরই আত্মীয়স্বজন? কাউকে সন্দেহ
করেন?’
‘সন্দেহ করি। কিন্তু কারুর নাম করব না।’
‘প্ৰাণ বাঁচাবার চেষ্টাও করবেন না?’
সত্যকাম মুখের একটা বিমর্ষ ভঙ্গী করিয়া উঠিবার উপক্রম করিল, ‘চেষ্টা করে লাভ নেই, ব্যোমকেশবাবু। আচ্ছা আজ উঠি, আর বোধহয় আপনার কোন প্রশ্ন নেই। রাত্তিরে আমার একটা অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট আছে।’
এই অ্যাপয়েণ্টমেন্ট যে ব্যবসায়ঘটিত নয় তাহা তাহার বাঁকা হাসি হইতে প্রমাণ হইল।
সে দ্বারের কাছে পৌঁছিলে ব্যোমকেশ পিছন হইতে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনাকে যদি কেউ খুন করে আমি জানব কী করে?’
সত্যকাম ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘খবরের কাগজে পাবেন। তা ছাড়া আপনি খোঁজ খবর নিতে পারেন। বেশি দিন বোধ হয় অপেক্ষা করতে হবে না।’
সত্যকাম প্রস্থান করিলে আমি দরজা বন্ধ করিয়া তক্তপোশে আসিয়া বসিলাম। সত্যবতী। হাসি-ভরা মুখে পুনঃপ্রবেশ করিল। মনে হইল সে দরজার আড়ালেই ছিল। ‘এক হাজার টাকার জন্যে ভাবছিলো, পেলে তো এক হাজার টাকা।’ ব্যোমকেশ বিরস মুখে নোটগুলি সত্যবতীর দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিল, ‘পিপীলিকা খায় চিনি, চিনি যোগান চিন্তামণি। আর কি, এবার কাশ্মীর যাত্রার উদ্যোগ আয়োজন শুরু করে দাও।’ আমাকে বলিল, ‘কেমন দেখলে ছোকরাকে?’
বলিলাম, ‘এত কম বয়সে এমন দু-কানকাটা বেহায়া আগে দেখিনি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমিও না। কিন্তু আশ্চৰ্য, নিজের প্রাণ বাঁচাতে চায় না, মরার পর অনুসন্ধান করাতে চায়!’
২
পরদিন সকালবেলা সত্যবতী বলিল, ‘কাশ্মীর যে যাবে, লেপ বিছানা কৈ?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কেন, গত বছর পাটনায় তো ছিল।’
সত্যবতী বলিল, ‘সে তো সব দাদার। আমাদের কি কিছু আছে! নেহাত কলকাতার শীত, তাই চলে যায়। কাশ্মীর যেতে হলে অন্তত দুটো বিলিতি কম্বল চাই। আর আমার জন্যে একটা বীভার-কোট।’
‘হুঁ। চল অজিত, বেরুনো যাক।’
প্রশ্ন করিলাম, ‘কোথায় যাবে?’
সে বলিল, ‘চল, সুচিত্রা এম্পেরিয়মে যাই। রথ দেখা কলা বেচা দুইই হবে।’
বলিলাম, ‘সত্যবতীও চলুক না, নিজে পছন্দ করে কেনাকাটা করতে পারবে।’
ব্যোমকেশ সত্যবতীর পানে তাকাইল, সত্যবতী করুণ স্বরে বলিল, ‘যেতে তো ইচ্ছে করছে, কিন্তু যাই কী করে? খোকার ইস্কুলের গাড়ি আসবে যে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তোমার যাবার দরকার নেই। আমি তোমার জিনিস পছন্দ করে নিয়ে আসব। দেখো, অপছন্দ হবে না।’
সত্যবতী ব্যোমকেশের পানে সহাস্য কটাক্ষপাত করিয়ে ভিতরে চলিয়া গেল, ব্যোমকেশের পছন্দের উপর তাহার যে অটল বিশ্বাস আছে তাহাই জানাইয়া গেল। সত্যবতীর শৌখিন জিনিসের কেনাকাটা অবশ্য চিরকাল আমিই করিয়া থাকি। কিন্তু এখন বসন্তকাল পড়িয়াছে, ফাল্গুন মাস চলিতেছে–