রক্তের দাগ

সন্ধ্যাবেলা ব্যোমকেশ আমাকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইল। এবার গতি আমহার্স্ট স্ট্রীটের দিকে। ৩৩/৩৪ নম্বর বাড়ির সম্মুখে যখন পৌঁছিলাম তখন ঘোর ঘোর হইয়া আসিয়াছে। প্রদোষের এই সময়টিতে কলিকাতার ফুটপাথেও ক্ষণকালের জন্য লোক-চলাচল কমিয়া যায়‌, বোধ করি রাস্তার আলো জ্বলার প্রতীক্ষ্ণ করে। আমরা উদ্দিষ্ট বাড়ির সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলাম। বেশি পথিক নাই, কেবল গায়ে চাদর-জড়ানো একটি লোক ফুটপাথে ঘোরাফেরা করতেছিল, আমাদের দেখিয়া একটু দূরে সরিয়া গেল।

৩৩/৩৪ নম্বর বাড়ি একেবারে ফুটপাথের উপর নয়। প্রথমে একটি ছোট লোহার ফটক‌, ফটক হইতে গলির মত সরু ইট-বাঁধানো রাস্তা কুড়ি-পঁচিশ ফুট। গিয়া বাড়ির সদরে ঠেকিয়ছে। দোতলা বাড়ি‌, সম্মুখ হইতে খুব বড় মনে হয় না। সদর দরজার দুই পাশে দুইটি জানালা‌, জানালার মাথার উপর দোতলায় দুইটি গোলাকৃতি ব্যালকনি। বাড়ির ভিতরে এখনও আলো জ্বলে নাই। ফুটপাথে দাঁড়াইয়া মনে হইল একটি স্ত্রীলোক দোতলার একটি ব্যালকনিতে বসিয়া বই পড়িতেছে কিংবা সেলাই করিতেছে। ব্যালকনির ঢালাই লোহার রেলিঙের ভিতর দিয়া অস্পষ্টভাবে দেখা গেল।

‘ব্যোমকেশবাবু!’

ছন হইতে অতর্কিত আহ্বানে দু’জনেই ফিরিলাম। গায়ে চাদর-জড়ানো যে লোকটিকে ঘোরাফেরা করিতে দেখিয়ছিলাম‌, সে আমাদের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। পুষ্টকায় যুবক,  মাথায় চুল ছোট করিয়া ছাঁটা‌, মুখখানা যেন চেনা-চেনা মনে হইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কে?’

যুবক বলিল‌, ‘আমাকে চিনতে পারলেন না। স্যার? সেদিন সরস্বতী পুজোর চাঁদা নিতে গিয়েছিলাম। আমার নাম নন্দ ঘোষ‌, আপনার পাড়াতেই থাকি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মনে পড়েছে। তা তুমি ও-পাড়ার ছেলে‌, ভর সন্ধ্যেবেলা এখানে ঘোরাঘুরি করছ‌, কেন?’

‘আজ্ঞে–নন্দ ঘোষের একটা হাত চাদরের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া আবার তৎক্ষণাৎ চাদরের মধ্যে লুকাইল। তবু দেখিয়া ফেলিলাম‌, হাতে একটি ভিন্দিপাল। অর্থাৎ দেড় হেতে খেঁটে। বস্তুটি আকারে ক্ষুদ্র হইলেও বলবান ব্যক্তির হাতে মারাত্মক অস্ত্র। ব্যোমকেশ সন্দিগ্ধ নেত্ৰে নন্দ ঘোষকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘কী মতলব বল দেখি?’

‘মতলব-আজ্ঞে নন্দ একটু কাছে ঘেঁষিয়া নিম্নস্বরে বলিল‌, ‘আপনাকে বলছি স্যার‌, এ-বাড়িতে একটা ছোঁড়া থাকে‌, তাকে ঠ্যাঙাব।’

‘তাই নাকি! ঠ্যাঙাবে কেন?’

‘কারণ আছে স্যার। কিন্তু আপনারা এখানে কী করছেন? এ-বাড়ির কাউকে চেনেন নাকি?’

‘সত্যকামকে চিনি। তাকেই ঠ্যাঙাতে চাও-কেমন?’

‘আজ্ঞে—’ নন্দ একটু বিচলিত হইয়া পড়িল‌, ‘আপনার সঙ্গে কি ওর খুব ঘনিষ্ঠতা আছে নাকি?’

‘ঘনিষ্ঠতা নেই। কিন্তু জানতে চাই ওকে কেন ঠ্যাঙাতে চাও। ও কি তোমার কোনও অনিষ্ট করেছে?’

‘অনিষ্ট–সে অনেক কথা স্যার। যদি শুনতে চান‌, আমার সঙ্গে আসুন; কাছেই ভুতেশ্বরের আখড়া‌, সেখানে সব শুনবেন।’

‘ভূতেশ্বরের আখড়া! ‘

‘আজ্ঞে আমাদের ব্যায়াম সমিতি। কাছেই গলির মধ্যে। চলুন।’

‘চল।’

ইতিমধ্যে রাস্তার আলো জ্বলিয়াছে। আমরা নন্দকে অনুসরণ করিয়া একটি গলির মধ্যে প্রবেশ করিলাম‌, কিছু দূর গিয়া একটি পাঁচলঘেরা উঠানের মত স্থানে পৌঁছিলাম। উঠানের পাশে গোটা দুই নোনাধরা জীৰ্ণ ঘরে আলো জ্বলিতেছে। উঠান প্রায় অন্ধকার‌, সেখানে কয়েকজন কপনিপরা যুবক ডন-বৈঠক দিতেছে‌, মুগুর ঘুরাইতেছে এবং আরও নানা প্রকারে দেহযন্ত্রকে মজবুত করিতেছে। নন্দ পাশ কাটাইয়া আমাদের ঘরে লইয়া গেল।

ঘরের মেঝোয় সতরঞ্চি পাতা; একটি অতিকায় ব্যক্তি বসিয়া আছেন। নন্দ পরিচয় করাইয়া দিল‌, ইনি ব্যায়াম সমিতির ওস্তাদ‌, নাম ভূতেশ্বর বাগ। সার্থকনামা ব্যক্তি‌, কারণ তাঁহার গায়ের রঙ ভূতের মতন এবং মুখখানা বাঘের মতন; উপরন্তু দেহায়তন হাতির মতন। মাথায় একগাছিও চুল নাই‌, বয়স ষাটের কাছাকাছি। ইনি বোধহয় যৌবনকালে গুণ্ডা ছিলেন অথবা কুস্তিগির ছিলেন‌, বয়োগতে ব্যায়াম সমিতি খুলিয়া বসিয়াছেন।

নন্দ বলিল‌, ‘ভুতেশ্বরদা‌, ব্যোমকেশবাবু মস্ত ডিটেকটিভ‌, সত্যকামকে চেনেন।’

ভুতেশ্বর ব্যোমকেশের দিকে বাঘা চোখ ফিরাইয়া বলিলেন‌, ‘আপনি পুলিসের লোক? ঐ ছোঁড়ার মুরুব্বি?’

ব্যোমকেশ সবিনয়ে জানাইল‌, সে পুলিসের লোক নয়‌, সত্যকামের সহিত তাহার আলাপও মাত্র একদিনের। সত্যকামকে প্রহার করিবার প্রয়োজন কেন হইয়াছে তাঁহাই শুধু জানিতে চায়‌, অন্য কোনও দুরভিসন্ধি নাই। ভুতেশ্বর একটু নরম হইয়া বলিলেন‌, ‘ছোঁড়া পগেয়া পাজি। পাড়ার কয়েকজন ভদ্রলোক আমাদের কাছে নালিশ করেছেন। ছোঁড়া মেয়েদের বিরক্ত করে। এটা ভদরলোকের পাড়া‌, এ-পাড়ায় ও-সব চলবে না।’

এই সময় আরও কয়েকজন গলদঘর্ম মল্লবীর ঘরে প্রবেশ করিল এবং আমাদের ঘিরিয়া বসিয় কটমট চক্ষে আমাদের নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। স্পষ্টই বোঝা গেল‌, সত্যকামকে ঠ্যাঙইবার সঙ্কল্প একজনের নয়‌, সমস্ত ব্যায়াম সমিতির অনুমোদন ইহার পশ্চাতে আছে। নিজেদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে শঙ্কিত হইয়া উঠিলাম। গতিক সুবিধার নয়‌, সত্যকামের ফাঁড়াটা আমাদের উপর দিয়া বুঝি যায়।

ব্যোমকেশ কিন্তু সামলাইয়া লইল। শান্তস্বরে বলিল‌, ‘পাড়ার কোনও লোক যদি বজ্জাতি করে তাকে শাসন করা পাড়ার লোকেরই কাজ‌, এ-কাজ অন্য কাউকে দিয়ে হয় না। আপনারা সত্যকামকে শায়েস্তা করতে চান তাতে আমার কোনই আপত্তি নেই। তাকে যতটুকু জানি দু’ ঘা পিঠে পড়লে তার উপকারই হবে। শুধু একটা কথা‌, খুনোখুনি করবেন না। আর‌, কাজটা সাবধানে করবেন‌, যাতে ধরা না পড়েন।’

0 Shares