‘কিন্তু–পুলিস তো অনুসন্ধানের ভার নিয়েছে, তার চেয়ে বেশি আপনি কী করতে পারবেন?’
‘কিছু করতে পারব। কিনা তা এখনও জানি না। তবে চেষ্টা করতে পারি।’
এত বড় শোকের মধ্যেও ঊষাপতিবাবু যে বিষয়বুদ্ধি হারান নাই। তাই তাহার পরিচয় এবার পাইলাম।
তিনি বলিলেন, ‘আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ, আপনাকে কত পারিশ্রমিক দিতে হবে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিছুই দিতে হবে না। আমার পারিশ্রমিক সত্যকামবাবু দিয়ে গেছেন।’
ঊষাপতিবাবু প্রখর চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, তারপর চোখ নামাইয়া বলিলেন, ‘ও। তা আপনি অনুসন্ধান করতে চান করুন। কিন্তু কোনও লাভ নেই, ব্যোমকেশবাবু।’
‘লাভ নেই কেন?’
‘সত্যকাম তো আর ফিরে আসবে না, শুধু জল ঘোলা করে লাভ কী?’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ স্থির নেত্ৰে ঊষাপতিবাবুর পানে চাহিয়া থাকিয়া ধীরস্বরে বলিল, ‘আপনার মনের ভাব আমি বুঝেছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, জল ঘোলা হতে আমি দেব না। আমার উদ্দেশ্য শুধু সত্য আবিষ্কার করা।’
ঊষাপতিবাবু একটি ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলিলেন, ‘বেশ। আমাকে কী করতে হবে বলুন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কাল কখন কীভাবে সত্যকামবাবুর মৃত্যু হয়েছিল আমি কিছুই জানি না। আপনি বলতে পারবেন কি?’
ঊষাপতিবাবুর মুখখানা যেন আরও ক্লিষ্ট হইয়া উঠিল, তিনি বুকের উপর একবার হাত বুলাইয়া বলিলেন, ‘আমিই বলি—আর কে বলবে? কাল রাত্রি একটার সময় আমি নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। দুম করে একটা আওয়াজ। মনে হল যেন সদরের দিক থেকে এল–’
‘মাফ করবেন, আপনার শোবার ঘর কোথায়?’
ঊষাপতিবাবু ছাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘এর ওপরের ঘর। আমি একই শুই, পাশের ঘরে স্ত্রী শোন।’
‘আর সত্যকামবাবু কোন ঘরে শুতেন?’
‘সত্যকাম নীচে শুত। ঐ যে বারান্দার ওপারে ঘরের দোরে তালা লাগানো রয়েছে ওটা তার শোবার ঘর ছিল। আমার স্ত্রীর শোবার ঘর ওর ওপরে।’
‘সত্যকামবাবু নীচে শুতেন কেন?’
ঊষাপতিবাবু উত্তর দিলেন না, উদাসচক্ষে বাহিরের জানালার দিকে তাকাইয়া রহিলেন। তাঁহার ভাবভঙ্গী হইতে স্পষ্টই বোঝা গেল যে, রাত্রিকালে নির্বিঘ্নে বহিৰ্গমন ও প্রত্যাবর্তনের সুবিধার জন্যই সত্যকাম নীচের ঘরে শয়ন করিত। তাহার রাত্রে বাড়ি ফিরিবার সময়েরও ঠিক ছিল না।
এই সময় ভিতর দিকের দরজার পদ সরাইয়া একটি মেয়ে হাতে সরবতের গেলাস লইয়া প্রবেশ করিল এবং আমাদের দেখিয়া থমকিয়া গেল, অনিশ্চিত স্বরে একবার ‘মামা-? বলিয়া ন যযৌ ন তস্থৌ হইয়া রহিল। মেয়েটির বয়স সতেরো-আঠারো, সুন্দরী নয় কিন্তু পুরন্ত গড়ন, চটক আছে। বর্তমানে তাহার মুখে-চোখে শঙ্কার কালো ছায়া পড়িয়াছে।
ঊষাপতিবাবু তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিলেন, ‘দরকার নেই।’ মেয়েটি চলিয়া গেল।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার বাড়িতে কে কে থাকে?’
ঊষাপতিবাবু বলিলেন, ‘আমরা ছাড়া আমার দুই ভাগনে ভাগনী থাকে।
‘এটি আপনার ভাগনী?
‘হ্যাঁ।’
‘কতদিন এরা আপনার কাছে আছে?’
‘বছরখানেক আগে ওদের বাপ মারা যায়। মা আগেই গিয়েছিল। সেই থেকে আমি ওদের প্রতিপালন করছি। বাড়িতে আমরা ক’জন ছাড়া আর কেউ নেই।’
‘চাকর-বাকর?’
‘পুরনো চাকর সহদেব বাড়িতেই থাকে। সে ছাড়া ঝি আর বামনী আছে, তারা রাত্রে থাকে না।’
‘বুঝেছি। তারপর কাল রাত্রির ঘটনা বলুন।’
ঊষাপতিবাবু চোখের উপর দিয়া একবার করতল চালাইয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ। আওয়াজ শুনে আমি ব্যালকনির দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। নীচে অন্ধকার, কিছু দেখতে পেলাম না। তারপরই সদর দরজার কাছ থেকে সহদেব চীৎকার করে উঠল…ছুটতে ছুটতে নীচে নেমে এলাম, দেখি সহদেব দরজা খুলেছে, আর–সত্যকাম দরজার সামনে পড়ে আছে। প্ৰাণ নেই, পিঠের দিক থেকে গুলি ঢুকেছে।’
‘গুলি! বন্দুকের গুলি?’
‘হ্যাঁ। সত্যকাম রোজই দেরি করে বাড়ি ফিরত। সহদেব বরান্দায় শুয়ে থাকত, দরজায় টোকা পড়লে উঠে দোর খুলে দিত। কাল সে টোকা শুনে দোর খোলবার আগেই কেউ পিছন দিক থেকে সত্যকামকে গুলি করেছে।’
‘গুলি। আমি ভেবেছিলাম—’ ব্যোমকেশ থামিয়া বলিল, ‘তারপর বলুন।’
ঊষাপতিবাবু একটা চাপা নিশ্বাস ফেলিলেন, ‘তারপর আর কী? পুলিসে টেলিফোন করলাম।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নতমুখে চিন্তা করিল, তারপর মুখ তুলিয়া বলিল, ‘সত্যকামবাবুর ঘরে তালা কে লাগিয়েছে?’
ঊষাপতি বলিলেন, ‘সত্যকাম যখনই বাড়ি বেরুত, নিজের ঘরে তালা দিয়ে যেত। কালও বোধহয় তালা দিয়েই বেরিয়েছিল, তারপর–’
‘বুঝেছি। ঘরের চাবি তাহলে পুলিসের কাছে?
‘খুব সম্ভব।’
‘পুলিস ঘর খুলে দেখেনি?
‘না।’
‘যাক, আপনার কাছে আর বিশেষ কিছু জানবার নেই। এবার বাড়ির অন্য সকলকে দু’ একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।’
‘কাকে ডাকব বলুন।’
‘সহদেব বাড়িতে আছে?’
‘আছে নিশ্চয়। ডাকছি।’
আসিয়া বসিলেন।
সহদেব প্রবেশ করিল। জরাজীর্ণ বৃদ্ধ, শরীরে কেবল হাড় ক’খানা আছে। মাথায় ঝাঁকড়া পাকা চুল, ভ্রূ পাকা, এমন কি চোখের মণি পর্যন্ত ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছে। লোলচর্ম শিথিলপেশী মুখে হাবলার মত ভাব।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমার নাম সহদেব? তুমি কত বছর এ-বাড়িতে কাজ করছ?’
সহদেব উত্তর দিল না, ফ্যালফ্যাল করিয়া একবার আমাদের দিকে একবার ঊষাপতিবাবুর দিকে তাকাইতে লাগিল। ঊষাপতিবাবু বলিলেন, ‘ও আমার শ্বশুরের সময় থেকে এ-বাড়িতে আছে–প্ৰায় পঁয়ত্ৰিশ বছর।’
ব্যোমকেশ সহদেবকে বলিল, ‘তুমি কাল রাত্ৰে–‘