ব্যোমকেশ কথা শেষ করিবার আগেই সহদেব হাত জোড় করিয়া বলিল, ‘আমি কিছু জানিনে বাবু।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার কথাটা শুনে উত্তর দাও। কাল রাত্রে সত্যকামবাবু যখন দোরে টোকা দিয়েছিলেন তখন তুমি জেগে ছিলে?’
সহদেব পূর্ববৎ জোড়হস্তে বলিল, ‘আমি কিছু জানিনে বাবু।’
ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহাকে বিদ্ধ করিয়া বলিল, ‘মনে করবার চেষ্টা কর। সে-সময় দুম্ করে একটা আওয়াজ শুনেছিলে?’
‘আমি কিচ্ছু জানিনে বাবু।’
অতঃপর ব্যোমকেশ যত প্রশ্ন করিল সহদেব তাহার একটিমাত্র উত্তর দিল-আমি কিছু জানিনে বাবু। এই সবাঙ্গীন অজ্ঞতা কতখানি সত্য অনুমান করা কঠিন; মোট কথা সহদেব কিছু জানিলেও বলিবে না। ব্যোমকেশ বিরক্ত হইয়া বলিল, ‘তুমি যেতে পোর। ঊষাপতিবাবু্, এবার আপনার ভাগনীকে ডেকে পাঠান।’
ঊষাপতিবাবু সহদেবকে বলিলেন, ‘চুমকিকে ডেকে দে।’
সহদেব চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে চুমকি প্রবেশ করিল, চেষ্টাকৃত দৃঢ়তার সহিত টেবিলের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। দেখিলাম তাহার মুখে আশঙ্কার ছায়া আরও গাঢ় হইয়াছে, আমাদের দিকে চোখ তুলিয়াই আবার নত করিল।
ব্যোমকেশ সহজ সুরে বলিল, ‘তোমার মামার কাছে শুনলাম তুমি বছরখানেক হল এ-বাড়িতে এসেছ। আগে কোথায় থাকতে?
চুমকি ধরা-ধরা গলায় বলিল, ‘মানিকতলায়।’
‘লেখাপড়া করে?’
‘কলেজে পড়ি।’
‘আর তোমার ভাই?’
‘দাদাও কলেজে পড়ে।’
‘আচ্ছা, কাল রাত্তিরে তুমি কখন জানতে পারলে?’
চুমকি একটু দাম লইয়া আস্তে আস্তে বলিল, ‘আমি ঘুমোচ্ছিলুম। দাদা এসে দোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগল, তখন ঘুম ভাঙল।’
‘ও—তুমি রাত্তিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে শোও?’
চুমকি যেন থতমত খাইয়া গেল, বলিল, ‘হ্যাঁ।’
‘তোমার শোবার ঘর নীচে না ওপরে?’
নীচে পিছন দিকে। আমার ঘরের পাশে দাদার ঘর।’
‘তাহলে বন্দুকের আওয়াজ তুমি শুনতে পাওনি?’
‘না।’
‘ঘুম ভাঙার পর তুমি কী করলে?’
‘দাদা আর আমি এই ঘরে এলুম। মামা পুলিসকে ফোন করেছিলেন।’
‘আর তোমার মামীমা?’
‘তাঁকে তখন দেখিনি। এখান থেকে ওপরে গিয়ে দেখলুম। তিনি নিজের ঘরের মেঝোয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।’ চুমকির চোখ জলে ভরিয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ সদয় কষ্ঠে বলিল, ‘আচ্ছা, তুমি এখন যাও। তোমার দাদাকে পাঠিয়ে দিও।’
চুমকি ঘরের বাহিরে যাইতে না যাইতে তাহার দাদা ঘরে প্রবেশ করিল; মনে হইল সে দ্বারের বাহিরে অপেক্ষা করিয়া ছিল। ভাই বোনের চেহারায় খানিকটা সাদৃশ্য আছে। কিন্তু ছেলেটির চোখের দৃষ্টি একটু অদ্ভুত ধরনের। প্যাঁচার চোখের মত তাহার চোখেও একটা নির্নিমেষ আচঞ্চল একাগ্রতা। সে অত্যন্ত সংযতভাবে টেবিলের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল এবং নিম্পলেক চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল।
সওয়াল জবাব আরম্ভ হইল।
‘তোমার নাম কী?’
‘শীতাংশু দত্ত।’
‘বয়স কত?’
‘কুড়ি।’
‘কাল রাত্ৰে তুমি জেগে ছিলে?’
‘হাঁ।’
‘কী করছিলে?’
‘পড়ছিলাম।’
‘কী পড়ছিলে? পরীক্ষার পড়া?’
‘না। গোর্কির ‘লোয়ার ডেপথস পড়ছিলাম। রাত্রে পড়া আমার অভ্যাস।’
‘ও…বিন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলে?’
‘পেয়েছিলাম। কিন্তু বন্দুকের আওয়াজ বলে বুঝতে পারিনি।’
‘তারপর?’
সহদেবের চীৎকার শুনে গিয়ে দেখলাম।’
‘তারপর ফিরে এসে তোমার বোনকে জাগালে?’
‘হ্যাঁ।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চিবুকের তলায় করতল রাখিয়া বসিয়া রহিল। দেখিলাম ঊষাপতিবাবুও নির্লিপ্তভাবে বসিয়া আছেন, প্রশ্নোত্তরের সব কথা তাঁহার কানে যাইতেছে কিনা সন্দেহ। মনের অন্ধকার অতলে তিনি ডুবিয়া গিয়াছেন।
ব্যোমকেশ আবার সওয়াল আরম্ভ করিল।
‘তুমি রাত্রে শোবার সময় দরজা বন্ধ করে শোও?’
না, খোলা থাকে।’
‘চুমকির দোর বন্ধ থাকে?’
‘হ্যাঁ।। ও মেয়ে, তাই।’
‘যাক।–কাল রাত্ৰে সকলে শুয়ে পড়বার পর তুমি বাড়ির বাইরে গিয়েছিলে?’
‘না।’
‘সদর দরজা ছাড়া বাড়ি থেকে বেরুবার অন্য কোনও রাস্তা আছে?’
‘আছে। খিড়কির দরজা।’
‘না। বেরুলে আমি জানতে পারতাম। খিড়কির দরজা আমার ঘরের পাশেই। দোর খুললে ক্যাঁচ-কাঁচ শব্দ হয়। তাছাড়া রাত্রে খিড়কির দরজায় তালা লাগানো থাকে।’
‘তাই নাকি! তার চাবি কার কাছে থাকে?’
‘সহদেবের কাছে।’
‘হুঁ। সত্যকামবাবু রাত্ৰে দেরি করে বাড়ি ফিরতেন তুমি জান?’
‘জানি।’
‘রোজ জানতে পারতে কখন তিনি বাড়ি ফেরেন?’
‘রোজ নয়, মাঝে মাঝে পারতাম।’
‘আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পার।’
শীতাংশু আরও কিছুক্ষণ বোমকেশের পানে নিষ্পলক চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।
ব্যোমকেশ ঊষাপতিবাবুর দিকে ফিরিয়া ঈষৎ সঙ্কুচিত স্বরে বলিল, ‘ঊষাপতিবাবু্, এবার আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে কি?’
ঊষাপতিবাবু চমকিয়া উঠিলেন, ‘আমার স্ত্রী! কিন্তু তিনি—তাঁর অবস্থা—’
‘তাঁর অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তাঁকে এখানে আসতে হবে না, আমিই তাঁর ঘরে গিয়ে
‘দু’-একটা কথা—’
ব্যোমকেশের কথা শেষ হইল না, একটি মহিলা অধীর হস্তে পদ সরাইয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। তিনি যে ঊষাপতিবাবুর স্ত্রী, তাহাতে সন্দেহ রহিল না। ব্যোমকেশকে লক্ষ্য করিয়া তিনি তীব্র স্বরে বলিলেন, ‘কেন আপনি আমার স্বামীকে এমনভাবে বিরক্ত করছেন? কী চান আপনি? কেন এখানে এসেছেন?’
আমরা তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। মহিলাটির বয়স বোধকরি চল্লিশের কাছাকাছি কিন্তু চেহারা দেখিয়া আরও কম বয়স মনে হয়। রঙ ফরসা, মুখে সৌন্দর্যের চিহ্ন একেবারে লুপ্ত হয় নাই। বর্তমানে-তাঁহার মুখে পুত্রশোক অপেক্ষা ক্রোধই অধিক ফুটিয়াছে। ব্যোমকেশ অত্যন্ত মোলায়েম সুরে বলিল, ‘আমাকে মাফ করবেন, নেহাত কর্তব্যের দায়ে আপনাদের বিরক্ত করতে এসেছি–’