মহিলাটি বলিলেন, ‘কে ডেকেছে। আপনাকে? এখানে আপনার কোনও কর্তব্য নেই। যান আপনি, আমাদের বিরক্ত করবেন না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি কি চান না যে সত্যকামবাবুর মৃত্যুর একটা কিনারা হয়?’
‘না, চাই না। যা হবার হয়েছে। আপনি যান, আমাদের রেহাই দিন।’
‘আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।’
আমরা ঊষাপতিবাবুর পানে চাহিলাম। তিনি বিস্ময়াহতভাবে স্ত্রীর পানে চাহিয়া আছেন, যেন নিজের চক্ষুকৰ্ণকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না। মহিলাটিও একবার স্বামীর প্রতি দৃষ্টি ফিরাইলেন, তারপর দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
৪
আমরা সদর দরজার বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলাম। ঊষাপতিবাবুও আমাদের পিছন পিছন আসিয়াছিলেন, তাঁহার মুখের বিস্ময়াহত ভাব সম্পূর্ণ কাটে নাই। তিনি দ্বার বন্ধ করিয়া দিবার উপক্রম করিয়া বলিলেন, ‘আমাদের মানসিক অবস্থা বুঝে ক্ষমা করবেন। নমস্কার।’
দরজা প্ৰায় বন্ধ হইয়া আসিয়াছে, এমন সময় ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওটা কী?’
আসিবার সময় চোখে পড়ে নাই, কবাটের
উচুতে একটি সোনালী চাকতি চকচক করিতেছে। ঊষাপতিবাবু দ্বার বন্ধ করিতে গিয়া থামিয়া গেলেন। চাকতিটা আয়তনে চাঁদির টাকার চেয়ে কিছু বড়। ব্যোমকেশ নত হইয়া সেটা দেখিল, আঙুল দিয়া সেটা পরীক্ষা করিল। বলিল, ‘রাংতার চাকতি, গদ দিয়ে কবাটে জোড়া রয়েছে।’ সে সোজা হইয়া ঊষাপতিবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘এটা কী?’
ঊষাপতিবাবু দ্বিধাভরে বলিলেন, ‘কী জানি, আগে লক্ষ্য করেছি বলে মনে হচ্ছে না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সম্প্রতি কেউ সেঁটেছে। বাড়িতে ছোট ছেলেপিলে থাকলে বোঝা যেত। কিন্তু–আপনি একবার খোঁজ নেবেন?’
ঊষাপতিবাবু সহদেবকে ডাকিলেন, সে যথারীতি বলিল, ‘আমি কিছু জানিনে বাবু।’চুমকিও কিছু বলিতে পারিল না। শীতাংশু বলিল, ‘আমি কাল সন্ধের সময় যখন বাড়ি এসেছি তখন ওটা ছিল না।’
আমার মাথায় নানা চিন্তা আসিতে লাগিল। সত্যকামকে যে খুন করিয়াছে সে কি নিজের পরিচয়ের ইঙ্গিত এইভাবে রাখিয়া গিয়াছে? হরতনের টেক্কা! লোমহর্ষণ উপন্যাসে এই ধরনের জিনিস দেখা যায় বটে। কিন্তু–
কোনও হদিস পাওয়া গেল না। আমরা চলিয়া আসিলাম।
রাস্তায় বাহির হইয়া ব্যোমকেশ হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘এখনও দশটা বাজেনি। চল, থানাটা ঘুরে যাওয়া যাক।’
থানার দিকে চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ এক সময় জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাড়ির লোকের এজেহার শুনলে। কী মনে হল?’
এই কথাটাই আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাইতেছিল। বলিলাম, ‘কাউকেই খুব বেশি শোকার্ত মনে হল না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রবাদ আছে, অল্প শোকে কাতর, বেশি শোকে পাথর।’
বলিলাম, ‘প্রবাদ থাকতে পারে, কিন্তু ঊষাপতিবাবু এবং তাঁর স্ত্রীর আচরণ খুব স্বাভাবিক নয়। সত্যকাম ভাল ছেলে ছিল না, নিজের উচ্ছঙ্খলতায় বাপমা’কে অতিষ্ঠা করে তুলেছিল, সবই সতি্যু হতে পারে। তবু ছেলে তো। একমাত্র ছেলে। আমার বিশ্বাস এই পরিবারের মধ্যে কোথাও একটা মস্ত গলদ আছে।’
‘অবশ্য। সত্যকামই তো একটা মস্ত গলদ। সে যাক, দরজায় রাংতার চাকতির অর্থ কিছু বুঝলে?’
‘না। তুমি বুঝেছি?’
‘সম্পূর্ণ আকস্মিক হতে পারে। কিন্তু তা যদি না হয়—’
থানায় পৌঁছিয়া দেখিলাম, দারোগা ভবানীবাবু আমাদের পরিচিত লোক। বয়স্থ ব্যক্তি; ক্বশ-বেল্ট টেবিলের উপর খুলিয়া রাখিয়া কাজ করিতেছেন। আমাদের দেখিয়া খুব খুশি হইয়াছেন মনে হইল না। তবু যথোচিত শিষ্টতা দেখাইয়া শেষে খাটো গলায় বলিলেন, ‘আপনি আবার এর মধ্যে কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘পকেচক্ৰে জড়িয়ে পড়েছি।’
ভবানীবাবু পূর্ববৎ নিম্নস্বরে বলিলেন, ‘ছোঁড়া পাকা শয়তান ছিল। যে তাকে খুন করেছে সে সংসারের উপকার করেছে। এমন লোককে মেডেল দেওয়া উচিত।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা বটে। আপনারা যা করছেন করুন, আমি তার মধ্যে নাক গলাতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই–’
ভবানীবাবু তাহাকে দৃষ্টি-শিলাকায় বিদ্ধ করিয়া বলিলেন, ‘সত্যান্বেষণ? কী জানতে চান বলুন।’
‘পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এখনও বোধহয় আসেনি?’
‘না। সন্ধ্যে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে।’
‘সন্ধ্যোর পর আমি আপনাকে ফোন করব-বন্দুকের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে?’
‘বড় বন্দুক নয়, পিস্তল কিম্বা রিভলবার। গুলিটা পিঠের বা দিকে ঢুকেছে, সামনে কিন্তু বেরোয়নি। শরীরের ভিতরেই আছে। পিঠে যে ফুটো হয়েছে সেটা খুব ছোট, তাই মনে হয় পিস্তল কিম্বা রিভলবার।’
‘পিঠের দিকে ফুটো হয়েছে, তার মানে যে গুলি করেছে সে সত্যকমের পিছনে ছিল।’
‘হ্যাঁ। হয়তো ফটকের ভিতর দিকে ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিল, যেই সত্যকাম সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে অমনি গুলি করেছে, তারপর ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’
‘হুঁ। এ-পাড়ায় একটা ব্যায়াম সমিতি আছে আপনি জানেন? ‘জানি। তাদের কাজ নয়। তারা দু-চার ঘা প্রহার দিতে পারে, খুন করবে না, সবাই ভদ্রলোকের ছেলে।’
ভদ্রলোকের ছেলে খুন করে না, পুলিসের মুখে একথা নুতন বটে। কিন্তু ব্যোমকেশ সেদিক দিয়া গেল না, বলিল ‘ভদ্রলোকের ছেলের কথায় মনে পড়ল। সত্যকমের এক পিসতুতো ভাই বাড়িতে থাকে, তাকে দেখেছেন?’
ভবানীবাবু একটু হাসিলেন, ‘দেখেছি। পুলিসে তার নাম আছে।’
‘তাই নাকি! কী করেছে। সে?’
‘ছেলেটা ভালই ছিল, তারপর গত দাঙ্গার সময় ওর বোপকে মুসলমানেরা খুন করে। সেই থেকে ওর স্বভাব বদলে গেছে। আমাদের সন্দেহ ও কম-সে-কম গোটা তিনেক খুন করেছে। অবশ্য পাকা প্রমাণ কিছু নেই।’