‘ওর চোখের চাউনি দেখে আমারও সেই রকম সন্দেহ হয়েছিল। আপনার কি মনে হয় এ-ব্যাপারে তার হাত আছে?’
‘কিছুই বলা যায় না, ব্যোমকেশবাবু। সত্যকমের মত পাঁঠা যেখানে আছে সেখানে সবই সম্ভব। তবে যতদূর জানতে পারলাম যখন খুন হয় তখন সে বাড়ির মধ্যে ছিল। সহদেবের চীৎকার শুনে ওর মামা আর ও একসঙ্গে সদর দরজায় পৌঁচেছিল। সত্যকামকে পিছন থেকে যে গুলি করেছে তার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।’
ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘ছাতের ওপর থেকে গুলি করা কি সম্ভব?’
ভবানীবাবু বলিলেন, ‘ছাতের ওপর গুলি করলে গুলিটা শরীরের ওপর দিক থেকে নীচের দিকে যেত। গুলিটা গেছে। পিছন দিক থেকে সামনের দিকে। সুতরাং—’
এই সময় টেলিফোন বাজিল। ভবানীবাবু টেলিফোনের মধ্যে দু’চার কথা বলিয়া আমাদের কহিলেন, ‘আমাকে এখনি বেরুতে হবে। জোর তলব–’
‘আমরাও উঠি।’ ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘ভাল কথা, মৃত্যুকালে সত্যকমের সঙ্গে কী কী জিনিস ছিল–’
‘ঐ যে পাশের ঘরে রয়েছে, দেখুন না গিয়ে।’ বলিয়া ভবানীবাবু কোমরে কেল্ট বাঁধিতে লাগিলেন।
পাশের ঘরে একটি টেবিলের উপর কয়েকটি জিনিস রাখা রহিয়াছে। সোনার সিগারেট-কেসটি দেখিয়াই চিনিতে পারিলাম। তাছাড়া হুইস্কির ফ্ল্যাসিক, চামড়ার মনিব্যাগ, একটি ছোট বৈদ্যুতিক টর্চ প্রভৃতি রহিয়াছে। ব্যোমকেশ সেগুলির উপর একবার চোখ বুলাইয়া ফিরিয়া আসিল। ভবানীবাবু এতক্ষণে কেল্ট বাঁধা শেষ করিয়াছেন, দেরাজ হইতে পিস্তল লইয়া কোমরের খাপে পুরিতেছেন। বলিলেন, ‘দেখলেন? আর কিছু দেখবার নেই তো? আচ্ছা, চলি।’
ভবানীবাবু চলিয়া গেলেন। তাঁহার ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল, তিনি আসামীকে ধরিবার কোনও চেষ্টাই করিবেন না। শেষ পর্যন্ত সত্যকমের মৃত্যু-রহস্য অমীমাংসিত থাকিয়া যাইবে।
আমরাও বাহির হইলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘এতদূর যখন এসেছি, চল বাগের আখড়া দেখে যাই।’
‘এখন কি কারুর দেখা পাবে?’
‘দেখাই যাক না। আর কেউ না থাক বাগ মশাই নিশ্চয় গুহায় আছেন।’
বাঘ কিন্তু গুহায় নাই। গিয়া দেখিলাম দরজায় তালা লাগানো। একজন ভৃত্য শ্রেণীর লোক দাওয়ায় বসিয়া বিড়ি টানিতেছিল, সে বলিল, ‘ভূতু সর্দারকে খুঁজতেছেন? আজ্ঞে তিনি আজ সকালের গাড়িতে কাশী গেছেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বল কি! একেবারে কাশী!-তুমি কে?’
লোকটি বলিল, ‘আজ্ঞে আমি তেনার চাকর। ঘর ঝাঁট দি, কাপড় কাচি, কলসীতে জল ভরি। আজ সকালে ঘর ঝাঁট দিতে এসে দেখনু সদার খবরের কাগজ পড়তেছেন। কলসীতে জল ভরে নিয়ে এনু, সদর সেজোগুজে তৈরি। কইলেন, আমি কাশী চক্ষু, সন্ধ্যেবেলা ছেলেরা এলে কয়ে দিও।’
বুঝিতে বাকী রহিল না, ভূতেশ্বর বাগ খবরের কাগজের সংবাদ পড়িয়াছেন এবং বিলম্ব না। করিয়া অন্তর্হিত হইয়াছেন।
বাসায় ফিরিলাম প্ৰায় সওয়া এগারোটায়। দেখি বন্ধ দরজার সামনে নন্দ ঘোষ প্রতীক্ষ্ণমাণভাবে পায়চারি করিতেছে। তাহার মুখ শুষ্ক, চোখে শঙ্কিত অস্বচ্ছন্দ্য। ব্যোমকেশ দ্বারের কড়া নাড়িয়া স্মিতমুখে নন্দকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কী খবর?’
‘আজ্ঞে স্যার…’ বলিয়া নন্দ ঠোঁট চাটিতে লাগিল।
পুঁটিরাম আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল, আমরা নন্দকে লইয়া ভিতরে আসিয়া বসিলাম। নন্দ আরও দু’চার বার ঠোঁট চাটিয়া বলিল, ‘সত্যকমের খবর শুনেছেন?’
ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল, ‘শুনেছি। তুমি কোথায় শুনলে?’
নন্দ বলিল, ‘সকালবেলায় ও-পাড়ায় এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম, খবর পেলাম কাল রাত্তিরে কেউ সত্যকামকে গুলি করে মেরেছে। আমি কিন্তু কিছু জানি না। স্যার। কাল সন্ধ্যেবেলা সেই যে আপনার আখড়া থেকে চলে এলেন, তারপর আমি আরও ওদিকে যাইনি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বোস, তোমাকে দু-চারটে কথা জিজ্ঞেস করি। ও-পাড়ায় তোমার জানাশোনার মধ্যে কারুর পিস্তল কিম্বা রিভলবার আছে?’
‘না স্যার। থাকলেও আমি জানি না।’
‘তোমাদের আখড়ায় কারুর নেই?’
‘জানি না। তবে একটা লোক ভূতেশ্বরের কাছে চোরাই পিস্তল বিক্রি করতে এসেছিল।’
‘চোরাই পিস্তল?’
‘হ্যাঁ স্যার। শুনেছি। যুদ্ধের পর অনেক চোরাই পিস্তল কিনতে পাওয়া যেত।’
‘ভুতেশ্বর কিনেছিল?’
‘তা জানি না। আমাদের সামনে কেনেনি।’
‘আচ্ছা, ও-কথা যাক।–সত্যকাম ভদ্রঘরের মেয়েদের পিছনে লাগত। কীভাবে পিছনে লগত বলতে পার?’
নন্দ কিয়ৎকাল চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘স্যার, সত্যকাম জাদুমন্ত্র জানত, দুটো কথা বলেই মেয়েগুলোকে বশ করে ফেলত। তারপর নিজের দোকানে নিয়ে যেত, ভাল ভাল জিনিস উপহার দিত, হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াত—’ কুষ্ঠিতভাবে সে চুপ করিল।
‘বুঝেছি। মেয়েরাও নেহাত নির্দোষ নয়।’ গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ সিগারেট টানিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘স্ত্রী-স্বাধীনতাও বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। যাক, কোন কোন ভদ্রলোকের মেয়ের সঙ্গে সত্যকমের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, তুমি বলতে পোর?
নন্দ আরও কুষ্ঠিত হইয়া পড়িল, ‘সকলের কথা জানি না। স্যার, তবে ৭৩ নম্বরের অখিলবাবু আমাদের ব্যায়াম সমিতিতে নালিশ করেছিলেন, তাঁর মেয়ে শোভনা–। তারপর রামেশ্বরবাবুর নাতনী–সেও কিছু দিন সত্যকমের ফাঁদে পড়েছিল, ভীষণ কেলেঙ্কারি হবার যোগাড় হয়েছিল। যাহোক, তার বিয়ে হয়ে গেছে—’
‘আর কেউ?’
‘আর–ভবানীবাবুর মেয়ে সলিলা–’
‘কোন ভবানীবাবু?’
‘ও-পাড়ার থানার দারোগা ভবানীবাবু। তিনি মেয়েকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলেন। তারপর এখন মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।’