রক্তের দাগ

স্বাধীনতা প্ৰাপ্তির পর প্রথম বসন্তঋতু আসিয়াছে। দক্ষিণ হইতে বিরবির বাতাস দিতে আরম্ভ করিয়াছে‌, কলিকাতা শহরের এখানে-ওখানে যে দুই চারিটা শহুরে গাছ আছে তাহাদের অঙ্গেও আরক্তিম নব-কিশলয়ের রোমাঞ্চ ফুটিয়াছে। শুনিয়াছি। এই সময় মনুষ্যদেহের গ্রন্থিগুলিতেও নূতন করিয়া রসসঞ্চার হয়।

ব্যোমকেশ তক্তপোশের উপর কান্ত হইয়া শুইয়া কবিতার বই পড়িতেছিল। আমি ভাবিতেছিলাম‌, ওরে কবি সন্ধ্যা হয়ে এল। আজকাল বসন্তকালের সমাগম হইলেই মনটা কেমন উদাস হইয়া যায়। বয়স বাড়িতেছে।

সন্ধ্যার মুখে সত্যবতী আমাদের বসিবার ঘরে প্রবেশ করিল। দেখিলাম। সে চুল বাঁধিয়াছে‌, খোঁপায় বেলফুলের মালা জড়াইয়াছে‌, পরনে বাসন্তী রঙের হাল্কা শাড়ি। অনেক দিন তাহাকে সাজগোজ করিতে দেখি নাই। সে তক্তপোশের পাশে বসিয়া হাসি-হাসি মুখে ব্যোমকেশকে বলিল‌, ‘কী রাতদিন বই মুখে করে পড়ে আছ। চল না কোথাও বেড়িয়ে আসি গিয়ে।’

ব্যোমকেশ সাড়া দিল না। আমি প্রশ্ন করিলাম‌, ‘কোথায় বেড়াতে যাবে? গড়ের মাঠে?’

সত্যবতী বলিল‌, ‘না না‌, কলকাতার বাইরে। এই ধরো-কাশ্মীর-কিম্বা–’

ব্যোমকেশ বই মুড়িয়া আস্তে-আস্তে উঠিয়া বসিল‌, থিয়েটারী ভঙ্গীতে ডান হাত প্রসারিত করিয়া বিশুদ্ধ মন্দাক্রান্তা ছন্দে আবৃত্তি করিল–

‘ইচ্ছা সম্যক ভ্বমণ গমনে

কিন্তু পাথেয় নাস্তি

পায়ে শিকলি মন উডুউডু

একি দৈবের শাস্তি।’

সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলাম‌, ‘এটা কোথেকে পেলে?’

‘হুঁ হুঁ-বলব কেন?’ ব্যোমকেশ আবার কাত হইয়া বই খুলিল।

হাতে কাজ না থাকিলে লোকে জ্যাঠার গঙ্গাযাত্রা করে‌, ব্যোমকেশ বাংলা সাহিত্যের পুরানো কবিদের লইয়া পড়িয়ছিল; ভারতচন্দ্ব হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত কবিকে একে একে শেষ করিতেছিল। ভয় দেখাইয়াছিল‌, অতি আধুনিক কবিদেরও সে ছাড়িবে না। আমি সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়ছিলাম‌, কোন দিন হয়তো নিজেই কবিতা লিখিতে শুরু করিয়া দিবে। আজকাল ছন্দ ও মিলের বালাই ঘুচিয়া যাওয়ায় কবিতা লেখার আর কোনও অন্তরায় নেই। কিন্তু সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ কবিতা লিখিলে তাহা যে কিরূপ মারাত্মক বস্তু দাঁড়াইবে ভাবিতেও শরীর কন্টকিত হয়। সেই যে খোকাকে একখানা আবোল তাবোলাঁ কিনিয়া দিয়াছিলাম‌, ব্যোমকেশের কাব্যিক প্রেরণার মূল সেইখানে। তারপর বইয়ের দোকানের অংশীদার হইয়া গোদের উপর বিষফোঁড়া হইয়াছে।

সত্যবতী ব্যোমকেশের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে একটি মোচড় দিয়া বলিল‌, ‘ওঠ না। আবার শুলে কেন?’

ব্যোমকেশ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, ‘কাশ্মীর যেতে কত খরচ জান?’

‘কত?’

‘অন্তত এক হাজার টাকা। অত টাকা পাব কোথায়?’

সত্যবতী রাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল‌, বলিল‌, ‘জানি না। আমি ওসব। যাবে কি না বল।’

‘বললাম তো টাকা নেই।’

এই সময় বহিদ্বারে টোকা পড়িল। বেশ একটি উপভোগ্য দাম্পত্য কলহের সূত্রপাত হইতেছিল‌, বাধা পড়িয়া গেল। সত্যবতী ব্যোমকেশকে কোপ-কটাক্ষে আধাপোড়া করিয়া দিয়া ভিতরের দিকে চলিয়া গেল।

ঘরের আলো জ্বালিয়া দ্বার খুলিলাম। যে লোকটি দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছে‌, তাহাকে দেখিয়া সহসা কিশোরবয়স্ক মনে হয়। বেশি লম্বা নয়‌, ছিপছিপে পাতলা গড়ন‌, গৌরবর্ণ সুশ্ৰী মুখে অল্প গোঁফের রেখা। বেশবাস পরিপাটি‌, পায়ে হরিণের চামড়ার জুতা হইতে গায়ে স্বচ্ছ মলমলের পাঞ্জাবি সমস্তাই অনবদ্য।

‘কাকে চান?’

‘সত্যান্বেষী ব্যোমকেশবাবুকে।’

‘আসুন।’ দ্বার ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইলাম।

লোকটি ঘরে প্রবেশ করিয়া উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোর সম্মুখে দাঁড়াইলে তাহার চেহারাখানা ভাল করিয়া দেখিলাম। যতটা কিশোর মনে করিয়াছিলাম ততটা নয়; বর্ণচোরা আম। চোখের দৃষ্টিতে দুনিয়াদারির ছাপ পড়িয়াছে‌, চোখের কোলে সূক্ষ্ম কালির আচড়‌, মুখের বাহ্য সৌকুমার্যের অন্তরালে হাড়ে পাক ধরিয়াছে। তবু বয়স বোধ করি পচিশের বেশি নয়।

ব্যোমকেশ তক্তপোশের পাশে বসিয়া আগন্তুককে নিরীক্ষণ করিতেছিল‌, উঠিয়া আসিয়া চেয়ারে বসিল। সামনের চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করিয়া বলিল‌, ‘বসুন। কী দরকার আমার সঙ্গে?’

লোকটি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না‌, চেয়ারে বসিয়া কিছুক্ষণ অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করিয়া শেষে বলিল‌, ‘আপনাকে দিয়ে আমার কাজ চলবে।’

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলিল‌, ‘তাই নাকি! কাজটা কী?

যুবক পাশের পকেট হইতে এক তাড়া নোট বাহির করিল‌, ব্যোমকেশের সম্মুখে অবহেলাভরে সেগুলি ফেলিয়া দিয়া বলিল‌, ‘আমার যদি হঠাৎ মৃত্যু হয়‌, আপনি আমার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করবেন। এই কাজ। পরে আপনার পারিশ্রমিক দেওয়া সম্ভব হবে না‌, তাই আগাম দিয়ে যাচ্ছি। এক হাজার টাকা গুনে নিন।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ কুঞ্চিত চক্ষে যুবকের পানে চাহিয়া রহিল‌, তারপর নোটের তাড়া শুনিয়া দেখিল। একশত টাকার দশ কেতা নোট। নোটগুলিকে টেবিলের এক পাশে রাখিয়া ব্যোমকেশ। অলসভাবে একবার আমার পানে চোখ তুলিল; তাহার চোখের মধ্যে একটু হাসির ঝিলিক খেলিয়া গেল। তারপর সে যুবকের মুখের উপর গভীর দৃষ্টি স্থাপন করিয়া বলিল‌, ‘আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনার কোজ নেব। কিনা তা নির্ভর করবে আপনার উত্তরের ওপর।’

যুবক সোনার সিগারেট কেস খুলিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে ধরিল‌, ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া প্রত্যাখ্যান করিল। যুবক তখন নিজে সিগারেট ধরাইয়া ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বলিল‌, ‘প্রশ্ন করুন। কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর না দিতেও পারি।’

ব্যোমকেশ একটু নীরব রহিল‌, তারপর অলসকণ্ঠে প্রশ্ন করিল‌, ‘আপনার নাম কী?’

0 Shares